ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও জনবল সংকটই প্রধান সমস্যা কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে
- আশরাফ আন নূর
- প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:২৯ PM , আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:০০ PM

প্রতিষ্ঠার দুই যুগ না পেরোতেই ভবনের ছাদ বেয়ে পড়ছে পানি। যা হাসপাতালের কর্মী ও চিকিৎসা আসা রোগীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।রয়েছে জনবল সংকটও। বলেছিলাম রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের কথা। ২০০১ সালের প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালের সার্বিক চিত্র তেমন ভালো না। তবে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা এখানকার চিকিৎসা ও সেবার মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
জানা যায়, ২০০১ সালের ১০ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। ২০০২ সালে কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি আর্থিক সংকটের কারণ দেখিয়ে এই হাসপাতাল থেকে তাদের অনুদান বন্ধ করে দেয়। ২০০২ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালটিকে এক চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকান হসপিটাল কনসোর্টিয়ামের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিল। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল ২০০৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে হাসপাতালটিকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নীত করা। কিন্তু আমেরিকান হসপিটাল কনসোর্টিয়াম সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটিকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিবার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হলে লিজ চুক্তি বাতিলের বিষয়টি ঝুলে যায়। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালটি পুনরায় চালু করা হয়।
২০১৬ সালের জুনে হাসপাতালটির দায়িত্ব কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। দুই বছর পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই হাসপাতালের জন্য নতুন পরিচালক নিয়োগ করেন। একই বছরের ডিসেম্বর ১০০ শয্যা বিশিষ্ট অভ্যন্তরীণ পরিষেবা চালু করা হয়। বর্তমানে সেটি ২৫০ শয্যতে উন্নীত করা হয়েছে। তাছাড়া প্রতিদিন আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।
মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) সরেজমিনে হাসপাতালে পরিদর্শনে যান এই প্রতিবেদক। কথা বলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও চিকিৎসা আসা রোগীদের সঙ্গে।
রোগীসেবা পরিস্থিতি জানার জন্য হাসপাতালের গাইনি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে ভর্তিচ্ছু রোগীরা চিকিৎসা ও সেবার মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। জরায়ুর সমস্যা, প্রস্রাবের ইনফেকশন ও মাসিকজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকা তিনজন নারী রোগীর অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে চিকিৎসার ইতিবাচক দিকগুলো।
গাজীপুরের মিরের বাজার থেকে আসা মরিয়ম (১৬) নামে এক কিশোরী দীর্ঘদিন ধরে জরায়ুর রক্তক্ষরণের সমস্যায় ভুগছেন। তার এই অসুখ যেন তাকে একটি অন্ধকার গলিতে আটকে রেখেছে। তিনি বলেন, হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর জীবনে যেন একটা নতুন আলো ফুটেছে। ডাক্তার ও নার্সরা আন্তরিকভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাদের ব্যবহারও ভালো। তবে কিছু মেডিসিন বাহির থেকে কিনে আনতে হচ্ছে।
দক্ষিণ খান এলাকা থেকে প্রস্রাবের ইনফেকশন নিয়ে আসা মোর্শেদা (৪০) মাত্র একদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার ভাষ্যে, ‘ডাক্তাররা প্রয়োজনীয় সব ওষুধ এখান থেকেই দেন। তিন বেলাই খাবার দেওয়া হয়, খাবারের মানও ভালো। এখন পর্যন্ত চিকিৎসার কোনো অবহেলা দেখিনি।’
উত্তরা থেকে আসা একজন কিশোরী পিরিয়ডজনিত সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তিনি সংক্ষেপে বলেন, ‘এখানে চিকিৎসা ভালোভাবে হচ্ছে।’
রোগী সেবা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, আমাদের হাসপাতালটি একটি কোভিড-ডেডিকেটেড হাসপাতাল। যেখানে নানা ধরনের রোগী চিকিৎসা গ্রহণের জন্য আসে। এখানে ২৬ বেডের আইসিইউ এবং কিডনি ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা রয়েছে। হাসপাতালটিতে মোট ৭১ জন ডাক্তার, ৮৯ জন নার্স এবং ১৬১ জন অন্যান্য স্টাফ কর্মরত।
তিনি বলেন, প্রতিদিন এখানে আউটডোরে রোগী সংখ্যা প্রায় ১৩০০ থেকে ১৪০০ এবং ইনডোরে ২৫০ রোগী ভর্তি থাকে। জরুরি বিভাগে ৪টি ইমার্জেন্সি বেড রয়েছে। এখানে জরুরি রোগী আসলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। তবে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের জন্য আরও ২১ জন মেডিকেল অফিসারের প্রয়োজন। কারণ বর্তমানে সেখানে মেডিকেল অফিসার নেই। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলন এবং এপিডেমিক পরিস্থিতিতে রোগীর চাপ অনেক বেড়ে যায় যা ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করে।
এদিকে হাসপাতালের সফলতা নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের বর্তমান সফলতা হলো Non-Communicable Disease (NCD) চিকিৎসা। এখানে মাত্র ১০ টাকা টিকেটে ৩৫৮০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব রোগীর গড়ে ৫০০ টাক সাশ্রয় হয়েছে। ভবিষ্যতে, আমাদের হাসপাতালটাকে কেন্দ্র করে একটি বিভাগীয় বিশেষায়িত হাসপাতালের ইউনিট গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে কিডনি, ক্যান্সার এবং হার্টের চিকিৎসা দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ইনফ্রাস্ট্রাকচার। বিশেষ করে হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের ছাদ দিয়ে পানি পড়া একটি ব্যাপক এবং অবহেলিত সমস্যা। এটি শুধুমাত্র হাসপাতালের ভবনের অবস্থা খারাপ করছে না বরং রোগী ও কর্মীদের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
‘‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো মেডিকেল অফিসারের অভাব। বর্তমানে হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের সঠিক সময়ে সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসকদের অভাবে অনেক রোগী ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না।’’
তিনি আরও বলেন, অপরদিকে মিডওয়াইফ (প্রসূতি চিকিৎসক) পদ সৃষ্টি করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রসবকালীন সময়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ মিডওয়াইফদের অভাবে, নারী রোগীদের জন্য উপযুক্ত সেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এই পদ সৃষ্টি হলে প্রসবের সময়ে রোগীদের জন্য আরো উন্নত সেবা প্রদান সম্ভব হবে এবং মাতৃমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে হাসপাতালের হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন বর্তমান হাসপাতালের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার। বিশেষ করে হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এটি রোগী এবং কর্মীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। এছাড়া হাসপাতালটিতে মেডিকেল অফিসারের অভাবও চরম আকার ধারণ করছে। ফলে সঠিক সময়ে রোগীদের সেবা প্রদান করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে প্রসবকালীন সেবা বৃদ্ধির জন্য মিডওয়াইফ (প্রসূতি চিকিৎসক) পদ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি।