ক্ষুধা লাগলে যে কারণে মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে
একটু দেরি করে দুপুরের খাবার খেলেন বা ট্রাফিকে আটকে থেকে সন্ধ্যার নাশতা বাদ গেল—ব্যস! আপনি যেন অল্পতেই রেগে যাচ্ছেন, বিরক্ত হচ্ছেন কিংবা অকারণে গম্ভীর হয়ে আছেন। পরিচিত লাগছে না? ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়া (ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘হ্যাংগার’—Hungry + Angry) খুব সাধারণ এক মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া।
এটি শুধু অনুভব নয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত যে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে আমরা হয়ে উঠি খিটখিটে, অস্থির, এমনকি কখনও আক্রমণাত্মক। এই চলুন জানি কেন ক্ষুধা লাগলে আমাদের মেজাজ এমন হয়।
শরীরে শক্তির অভাব: গ্লুকোজই আসল খেলোয়াড়
আমাদের শরীর বিশেষ করে মস্তিষ্ক, শক্তির জন্য নির্ভর করে এক ধরনের সহজ শর্করা, যার নাম গ্লুকোজ। এটি মূলত আমাদের খাবার থেকেই আসে। দীর্ঘক্ষণ না খেলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায়। ফলে মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে শুরু করে। এই অবস্থায় আমরা বোধ করি দুর্বলতা, বিভ্রান্তি, মনোযোগে সমস্যা এবং হঠাৎ করে রেগে যাওয়ার প্রবণতা।
আরও পড়ুন: তাড়াহুড়ো করে খাবার খান? জেনে নিন এর ভয়াবহ ফলাফল
হরমোনের খেলা: ঘ্রেলিন, কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন
খালি পেটে আমাদের শরীরে ক্ষুধার অনুভূতি সৃষ্টি করে একটি হরমোন যার নাম ঘ্রেলিন। এটি পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত হয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে খাবারের সংকেত পাঠায়। ঘ্রেলিনের সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন—এই দুটি স্ট্রেস হরমোন। এই হরমোনগুলো আমাদের শরীরে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ (লড়ো বা পালাও) প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা হয়ে উঠি উত্তেজিত এবং অস্থির।
ডোপামিন ও সেরোটোনিনের ভারসাম্য নষ্ট
ক্ষুধার কারণে শরীরে ডোপামিন ও সেরোটোনিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা কমে যেতে থাকে। এই দুটি রাসায়নিক আমাদের আনন্দ, প্রশান্তি এবং ইতিবাচক আবেগ বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে যখন এগুলোর মাত্রা কমে যায়, তখন মন খারাপ হতে থাকে এবং সামান্য বিষয়েও রাগারাগি হতে পারে।
গবেষণার ফলাফলে কী বলছে
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুধার্ত মানুষ তাদের আশপাশের পরিবেশ ও মানুষের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে, বিশেষ করে যখন তারা তাদের অনুভূতিগুলো নিয়ে সচেতন না থাকে। গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘ক্ষুধা আমাদের আবেগ ও আচরণের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।’
গবেষণায় অংশ নেওয়া একদল শিক্ষার্থীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, না খেয়ে থাকা অবস্থায় তাদের ধৈর্য কমে যায় এবং তারা অনেক বেশি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটি প্রমাণ করে যে ক্ষুধা শুধু শারীরিক চাহিদা নয়, এটি একধরনের মানসিক চ্যালেঞ্জও তৈরি করে।
কীভাবে সামলাবেন এই খিটখিটে মেজাজ?
নিয়মিত খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাবার খান। দীর্ঘ সময় পেটে কিছু না থাকলে শরীর ও মস্তিষ্ক উভয়েই প্রতিক্রিয়া দেখায়।
হাতে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস রাখুন: বাদাম, ফল, দই, ডার্ক চকোলেট কিংবা হালকা প্রোটিনসমৃদ্ধ স্ন্যাকস আপনাকে হ্যাংগ্রি হয়ে উঠা থেকে বাঁচাতে পারে।
আরও পড়ুন: রাত জেগে স্মার্টফোন ব্যবহার: অজান্তেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন?
পানি পান করুন: ডিহাইড্রেশনও মন-মেজাজ খারাপের কারণ হতে পারে। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুটিকেই গুরুত্ব দিন।
নিজের অনুভূতির প্রতি সচেতন হোন: রেগে যাওয়ার আগে একবার চিন্তা করুন, আপনি রেগে যাচ্ছেন নাকি আপনি ক্ষুধার্ত?
ক্ষুধা লাগলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়াটা শুধু আপনার একার সমস্যা নয়, এটি একেবারে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত একটি বিষয়। এই জৈবিক প্রতিক্রিয়াকে বোঝা এবং নিয়ন্ত্রণ করা মানেই আপনি আরও সুস্থ, সুখী এবং আত্মনিয়ন্ত্রিত একজন মানুষ। তাই খিদে পেটে নয়, শান্ত মনে জেগে থাকুন—ভালো খাবার আর ভালো ব্যবহারে!