নামমাত্র বেতন থেকে সম্মানজনক জীবনের পথে গ্রাম পুলিশ

গ্রাম পুলিশ
গ্রাম পুলিশ  © সংগৃহীত

যশোরের মনিরামপুরে গ্রাম পুলিশ পেশার প্রতি আগ্রহের যে চিত্র দুই দশক আগেও ছিল রীতিমতো সংকটপূর্ণ, তা এখন রীতিমতো রূপ নিয়েছে প্রতিযোগিতার। সামাজিক মর্যাদা, সামান্য বেতনভাতা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে একসময় এই পেশায় নিয়োগে ছিল তেমন কোনো আগ্রহই না। তখন গ্রাম পুলিশের পদে নিয়োগ দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। এখন চিত্র ভিন্ন। একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই কাঙ্খিত পদের চেয়ে বহু গুণ বেশি আবেদন জমা পড়ে, যার প্রেক্ষিতে নিয়োগ নিয়ে নানামুখী তদবিরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় কর্তৃপক্ষকে।

গ্রাম পুলিশের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, দায়িত্বের পরিধি বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক স্বীকৃতি বৃদ্ধির ফলে এখন এই পেশায় সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। শুধু পাহারা বা নিরাপত্তা নয়—বর্তমানে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ, যৌতুকবিরোধী প্রচার, গ্রাম আদালতের নোটিশ জারি থেকে শুরু করে নানা সামাজিক-প্রশাসনিক কাজে অবদান রাখছে গ্রাম পুলিশ বাহিনী।

গ্রাম পুলিশের ইতিহাসও প্রাচীন। মোঘল আমলে গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে সবার অংশগ্রহণে পাহারার ব্যবস্থা চালু ছিল। তখন তাদের পরিচিতি ছিল ‘পাশাবন’, ‘সিঘাবন’ বা ‘চৌকিদার’ নামে। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘পুলিশ আইন’ চালু করলে তাদের কার্যক্রম আইনি কাঠামোর আওতায় আসে। ১৮৭০ সালে চৌকিদার আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ ১৯৫৯-এর আওতায় চালু হয় দফাদার ও মহল্লাদার ব্যবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে স্থানীয় সরকার আইনের মাধ্যমে তারা পরিচিত হয় ‘গ্রাম পুলিশ’ নামে।

মনিরামপুর উপজেলার খানপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের আদালতের নোটিশ জারি করছেন হযরত আলী নামে একজন গ্রাম পুলিশ। তিনি জানান, ১৯৯৮ সালের ৪ এপ্রিল মাত্র সাড়ে তিনশ টাকা বেতনে এ পেশায় যোগ দেন তিনি। সে সময় গ্রামের যারা অন্য কোনো পেশায় নিজেকে যোগ্য ভাবতেন না, তারা বাধ্য হয়ে এই পেশায় আসতেন। হেয় দৃষ্টিতে দেখা হতো তাদের। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন তিনি পাচ্ছেন সাড়ে আট হাজার টাকা বেতন, যার অর্ধেক আসে সরকারি রাজস্ব খাত থেকে এবং বাকি অর্ধেক ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। ২০০১ সাল থেকে নিয়মিত ঈদ বোনাস পাচ্ছেন এবং ২০২৩ সাল থেকে তেরশ টাকা বৈশাখী ভাতা পেতেও শুরু করেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা পারভীনা খাতুন ও পদ্ধরানী কর্মকার বলেন, “গ্রাম পুলিশ আমাদের খোঁজখবর, সরকারি অনুদান, বিভিন্ন দাপ্তরিক তথ্য সবার আগে জানিয়ে দেয়। তারা এখন গ্রামে প্রশাসনের এক কার্যকর হাত।”

মনিরামপুর উপজেলা গ্রাম পুলিশ শাখার সভাপতি রবিউল ইসলাম জানান, ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার গ্রাম পুলিশকে জাতীয় বেতন স্কেলের চতুর্থ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতায় ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় নেতা লাল মিয়াসহ ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ উচ্চ আদালতে রিট করেন। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর আদালতের রায়ে গ্রাম পুলিশকে ২০তম ও ১৯তম গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

বর্তমানে মনিরামপুর উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে একজন দফাদার ও নয়জন মহল্লাদার করে মোট ১৭০ জন গ্রাম পুলিশ কাজ করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়েও তারা কাজ করে চলেছেন অবিচল নিষ্ঠায়। 

এক সময়ের অবহেলিত পেশাটিই এখন হয়ে উঠেছে গ্রামের এক অপরিহার্য অংশ—যেখানে দায়িত্ব, মর্যাদা আর সম্মান মিলছে সমানতালে।


সর্বশেষ সংবাদ