বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপথে শিক্ষার্থীরা!

টিকটক-লাইকিতেও বাড়ছে উদ্বেগ
টিকটক-লাইকিতেও বাড়ছে উদ্বেগ   © প্রতীকী ছবি

একসময় শিক্ষার্থীরা শুধু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও করোনায় তাদের জীবনাচরণে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে দীর্ঘছুটিতে স্মার্টফোনেই দিন-রাত কাটাচ্ছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন আসক্তি বিপথে ঠেলছে শিক্ষার্থীদের। তারা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সাইবার অপরাধে। পরিণত বয়সের আগেই অনলাইন ক্লাসের নামে হাতে হাতে স্মার্টফোন ও পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা থাকায় গেমিংয়ের ফাঁদে পড়েছে কিশোর-তরুণরা।

শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় শিক্ষার্থীরা ঝুঁকছেন ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক ও লাইকির মতো প্ল্যাটফর্মে। একটি সমীক্ষা বলছে, করোনাকালে এসব প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার হতাশাগ্রস্ত ও মানসিক সমস্যায় কেউ কেউ হয়ে উঠছে আত্নঘাতী৷ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ভেতর রাখতে অনলাইন ক্লাস চালু থাকলেও তাতে মিলছেনা কাঙ্ক্ষিত সুফল। করোনার শুরুতে অনলাইন ক্লাসে আগ্রহ থাকলেও সময় গড়াতেই তাতে অনীহা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর৷ এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরা৷

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীদের হাতে এখন পর্যাপ্ত সময়। সেইসাথে নেই পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপ। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ঘরে বসে স্মার্টফোনে আসক্তি হয়ে পড়েছে। অল্পবয়সে স্মার্টফোন হাতে পেয়ে নিজের ভালো-মন্দ না বুঝে নেট দুনিয়ার নেতিবাচক ব্যবহারে খুব সহসাই জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে। এখনই শিক্ষার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন আসক্তি থেকে মুক্ত করতে না পারলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চরম শঙ্কার মুখে পরবে বলে মনে করছেন তারা৷

চট্টগ্রামে বেসরকারি একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আমজাদ হোসেন ( ছদ্মনাম)। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে মায়ের স্মার্টফোন নিয়ে শুরুর দিকে অনলাইন ক্লাস করলেও দিন গড়াতেই জড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেট আসক্তিতে৷ বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ফ্রী ফায়ায়-পাবজি গেমস খেলেই এখন দিন-রাত কাটছে তার।

শিক্ষার্থীর মা বলেন, স্মার্টফোন রাখতে বললেই রাগান্বিত হয়ে ওঠে৷ মাত্রাতিরিক্ত অনলাইনে আসক্তির ফলে আচরণগত অনেক পরিবর্তন এসেছে।পড়াশোনার কথা বললেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম,কিছুই ঠিক নেই৷বাবা-মা কাউকেই এখন গুরুত্ব দেয়না৷

আমজাদের মতো কয়েক লাখ তরুণ শিক্ষার্থী এখন অনলাইন গেমস আসক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে৷সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় অনলাইন গেমস আসক্তির ভয়ংকর রূপ।

'চলতি বছর গত ২১মে দিনে চাঁদপুরে স্মার্টফোনে 'ফ্রি ফায়ার' গেম খেলার জন্য ইন্টারনেট কেনার টাকা না পেয়ে মামুন (১৪) নামের এক কিশোর আত্মহত্যা করেছে'।

'গত ২৪ মে বগুড়ায় স্মার্টফোনে ‘ফ্রি ফায়ার গেম’ খেলতে না দেওয়ায় চিরকুট লিখে উম্মে হাবিবা বর্ষা (১২) নামে এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তিনি বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। বর্ষা চিরকুটে লেখেন, ‘বাবা-মা আমাকে ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে দিত না। বকাঝকা করতো। তাই আমি চলে গেলাম। আমাকে আর বকাঝকা করতে হবে না’।

'গত ১৬ মে গেম খেলতে মোবাইল ফোন কিনে না দেওয়ায় গত শিবগঞ্জ উপজেলার আলাদিপুর এরুলিয়া গ্রামে ঘরে আড়ার সঙ্গে গলায় গামছার ফাঁস দিয়ে আখিরুল ইসলাম (১৩) নামে অষ্টম শ্রেণির এক স্কুল ছাত্র আত্মহত্যা করেছে'।

গবেষণা বলছে ,মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ের ফলে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ।গেমিং ডিজঅর্ডারের সঙ্গে অতি উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা এবং তীব্র মানসিক চাপের মতো মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে।

তীব্র মানসিক চাপের কারণে আত্নহননের পথও বেছে নিচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সংবাদকর্মীদের তৈরি এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৬ মাসে অন্তত ১৬৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

সর্বশেষ চলতি মাসের ৮ তারিখে মিছিলে যুক্ত হন স্কুলছাত্রী তানজিনা আক্তার। ময়মনসিংহে গলায় মাফলার পেঁচিয়ে আত্নহত্যা করে স্কুলছাত্রী তানজিনা আক্তার (১৪)। নিহত তানজিনা আক্তার হবিরবাড়ী ইউনিয়ন সোনার বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

পরিসংখ্যান বিবেচনায় মোট আত্নহননকারীর ৮২ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী,৩০ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ১০ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, শিক্ষার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত অনলাইনে আসক্তির ভয়াবহ চিত্র। পোল্যান্ডভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের পরিসংখ্যান বলছে, করোনা পরিস্থিতির আগে বাংলাদেশে মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার, গত মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার। প্রকাশিত পরিসংখ্যান বিবেচনায় মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর অর্ধেকই কিশোর-তরুণ। ফেসবুকের পাশাপাশি অন্যান্য জনপ্রিয় বিভিন্ন এপস টিকটিক, লাইক ইত্যাদির ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ১১ কোটি ২৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক, আর এদের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়।যার মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল ওয়াহাব বলেন, শিক্ষার্থীরা অনেকদিন ঘরে বন্দি। বন্ধু-বান্ধবের সান্নিধ্য পাচ্ছে না। সরকার অটোপাস দিলেও তা অনেক শিক্ষার্থীর কাছে কাম্য নয়। অনেক অভিভাবকের চাকরি চলে গেছে, আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংবাদে অনেকের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। এমন অনেক কারণে আত্মহনন করছে কেউ কেউ।

তিনি আরও বলেন, কোনো অভিভাবক তাদের সন্তানের আচরণ হঠাৎ অস্বাভাবিক দেখলে মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে আসতে হবে। এ সময়ে অভিভাবকদের দায়িত্ব সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও উদ্বিগ্ন ও বিষণ্নতায় ভুগলে তারা নিজ দায়িত্বে কাউন্সেলিং নিলে আত্মত্যার পরিমাণ কমে আসবে।