২৬ মে ২০২৫, ১৭:৪৮

রান্নার তেল: স্বাদের বাইরে স্বাস্থ্য ভাবনা

বিভিন্ন রান্নার তেল   © সংগৃহীত

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো রান্নার তেল। প্রতিদিনের খাবার রান্নায় যে তেল ব্যবহার করি, তা শুধুমাত্র স্বাদের জন্য নয়, আমাদের শরীরের স্বাস্থ্য, হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা, রক্তচাপ, ওজন নিয়ন্ত্রণ এমনকি দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের তেল পাওয়া যায়— জলপাই, সয়াবিন, নারিকেল, সরিষা, ক্যানোলা ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সব তেল কি আমাদের শরীরের জন্য উপকারী? উত্তর হলো, না। কিছু তেল আছে যেগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য আশীর্বাদ আবার কিছু তেল আছে যেগুলো নিঃশব্দ ঘাতকের মতো কাজ করে।

স্বাস্থ্যকর রান্নার তেল

জলপাই তেল

রান্নায় জলপাই তেলের চারটি মৌলিক ব্যবহার রয়েছে: সংরক্ষণকারী হিসেবে, রান্নার মাধ্যম হিসেবে, উপাদান হিসেবে এবং একটি ঘন মসলা বা কনডিমেন্ট হিসেবে। মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলের সংস্কৃতিগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একমাত্র রান্নার তেল হিসেবে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ব্যবহার করে আসছে এবং এই খাদ্যধারাটি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাস্থ্যর জন্য জলপাই তেল বেশ ভালো। স্বাস্থ্যকর জলপাই তেলে প্রচুর মনোআনস্যাচুরেটেড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে। তাই হার্টের জন্য এই তেল বেশ ভালো। ওজন কমানোর পর ফিটনেস ধরে রাখতে রান্নায় এই স্বাস্থ্যকর তেল ব্যবহার করা হয়। স্যাচুরেটেড ফ্যাট জলপাইয়ের তেলে খুব কম মাত্রায় থাকে। জলপাই তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বেশ উচ্চ মানের।

তিলের তেল

এই তেলে রয়েছে কিছুটা বাদামের স্বাদ। যে কারণে রান্নায় ও বেকিংয়ে কম ব্যবহার হয়। তবে এটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তিলের তেল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস’য়ের ভালো উৎস। যা দেহকোষ সুস্থ রাখে। এই তেলে আছে প্রদাহনাশক উপাদান। ফলে হৃদ্‌রোগ সংক্রান্ত অসুস্থতা যেমন ‘আথারোস্ক্লেরোসিস’ বা ‘প্লাক’জমে ধমনি আটকে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়।

এছাড়াও খাবার মেরিনেইট করতে বা ‘ডিপস’ তৈরি করতে এই তেল ব্যবহার করা যায়।

চিনা বাদামের তেল 

কিছু ক্ষতিকর দিক থাকলেও এর রয়েছে প্রচুর স্বাস্থ্যোপকারিতা। প্রথমত, এটি অলিয়েক অ্যাসিড সমৃদ্ধ। যা আমাদের খাবার তালিকা রাখার জন্য উপকারী। চিনা বাদামের তেলে রয়েছে ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। এছাড়া আনস্যাচুরেইটেড ফ্যাট রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

যদিও রয়েছে প্রদাহজনক উপাদান ওমেগা-সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিডস। ওমেগা থ্রি’য়ের অভাবে অধিক ওমেগা সিক্স গ্রহণ স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই ওমেগা সিক্স গ্রহণের উৎস সীমিত রাখা ভালো।

আরও পড়ুন: শিশুরা খাচ্ছে এনার্জি ড্রিংকস, শরীরে জমছে বিষ!

সরিষার তেল

সরিষার তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বেশি তাই ডিপ ফ্রাই করতে এই স্বাস্থ্যকর তেল ব্যবহার করা হয়। সরিষার তেলে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা মানব দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পেটে জীবাণুর সংক্রমণ বন্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে সরিষার তেল। দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে এই তেল ভূমিকা রাখে।

সরিষার তেলে প্রচুর পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। সরিষার তেলে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাট থাকে। এই ভালো ফ্যাটগুলো মস্তিষ্কে এবং হার্টে শক্তি যোগান দেয়।

সরিষার তেলে লিনোলেনিক ও লিনোলিক অ্যাসিডের অনুপাতে ওলেইক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে, যা অন্যান্য ভোজ্যতেলের তুলনায় স্বাস্থ্যকর।
সরিষার তেলে থাকা উচ্চমাত্রার আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড উচ্চ কোলেস্টেরল ও হৃদ্‌রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

ভালো গুণের পাশাপাশি সরিষার তেলের একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে, তা হলো এতে এরুসিক অ্যাসিড থাকে। এরুসিক অ্যাসিড হৃদপিণ্ডের পেশিতে ট্রাইগ্লিসারাইড জমা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে হৃদপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়াও, কিছু মানুষের ত্বকে সরিষার তেল ব্যবহার করলে অ্যালার্জি বা চুলকানি, র‍্যাশ ইত্যাদির মতো প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে পরিমিত ও সচেতন ব্যবহারে এই তেলের উপকারিতা এখনও অনেকটাই মূল্যবান, বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশের খাদ্যাভ্যাসে।

ক্যানোলা তেল

ইউরোপ ও আমেরিকা সরিষার ফুল ও বীজ সদৃশ উদ্ভিদ ক্যানোলার বীজ থেকে ক্যানোলা তেল মহাদেশে সংগ্রহ করা হয়। সয়াবিন তেলের প্রধান বিকল্প হলো ক্যানোলা তেল। স্যাচুরেটেড ফ্যাট এই তেলে খুব কম। পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও মনো স্যাচুরেটেড ফ্যাট এই তেলে বেশি। ওমেগা-৩ ফ্যাট এই তেলে বেশ ভালো মাত্রায় থাকে। হার্টের স্বাস্থ্যের জন্যে এই তেল বেশ ভালো। ক্যানোলা তেলের সাধারণত মাঝারি-উচ্চ ধোঁয়া ওঠার মাত্রা (স্মোক পয়েন্ট) থাকে, যার অর্থ এটি মাঝারি তাপে রান্নার জন্য উপযোগী, যেমন স্টির-ফ্রাই, এবং কিছু কিছু গ্রিলিংয়ের জন্যও এটি ব্যবহারযোগ্য।

উচ্চ অলিয়েক সমৃদ্ধ সূর্যমুখীর তেল

আনস্যাচুরেইটেড ফ্যাটস থাকার কারণে এই তেল স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে উচ্চ অলিয়েক সমৃদ্ধ হওয়াতে সূর্যমুখীর তেল ওমেগা-সিক্স গ্রহণের ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা রাখে। এই দুই উপাদানের সমন্বয়ে কারণে প্যান ফ্রাই অথবা সওতে এবং বেইক করা খাবার তৈরিতে বাটারের ভালো বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তেল

কর্ন অয়েল

কর্ন অয়েলে আছে প্রচুর পরিমাণে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, যা কিনা ক্যান্সার, অ্যাজমা, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ আরো নানা রোগের প্রধান কারণ। ক্ষতিকারক তেলের মাঝে এটির নাম এ জন্য সবার প্রথমে আসে। যদিও কর্ন অয়েলের কিছু ভালো দিকও রয়েছে, কিন্তু খারাপ দিকের জন্য এটি কম খাওয়াই ভালো। 

সয়াবিন তেল

আমাদের অতিপরিচিত এই সয়াবিন তেল নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এতে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ওমেগা-৬। এই উপাদান বেশি মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যার ফলে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বাড়ে। আবার ক্যান্সার, প্রদাহ এসবের জন্যও দায়ী করা হয় এই উপাদানকে। তাই সয়াবিন তেল ব্যবহার নিয়ে আরো একবার চিন্তা করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: হৃদ্‌রোগ-হাড় ক্ষয়ের নীরব ঘাতক লবণ, কাঁচা লবণে কি ঝুঁকি আরও বেশি?

সানফ্লাওয়ার অয়েল 

সানফ্লাওয়ার অয়েলেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড। তাই আপাতদৃষ্টিতে এই তেলকে নিরীহ মনে হলেও উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এই তেল। 

রাইস ব্র্যান অয়েল 

রাইস ব্র্যান অয়েল সাধারণত এর স্মোকি ফ্লেভার এবং এতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ই-এর জন্য প্রশংসিত হয়। তবে যদি অধিক পরিমাণে এই তেল খাওয়া হয় তাহলে শরীরের ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬-এর মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে এই তেল। যার ফলে দেখা দিতে পারে নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতা।

পাম অয়েল

পাম অয়েলের ব্যবহার সবখানেই অনেক বেশি। সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায় বলে সবাই কমবেশি রান্নায় এই তেল ব্যবহার করে থাকে। এতে বিদ্যমান উচ্চ মাত্রার স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে অতিরিক্ত এই তেল খাওয়া হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।