২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:৫৪

এক বছরে ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

আত্মহত্যার মিছিলে ৩৬ শিক্ষার্থী, ৬ জনই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের  © টিডিসি ফটো

করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে খুলেছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই মহামারির সময়ে এবং পরবর্তীতে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনা। চলতি ২০২১ সালে বিভিন্ন  বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ৩৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। 

আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক সমস্যা, নি:সঙ্গতা, মানসিক চাপ ও তীব্র বিষন্নতাকে প্রধানত চিহ্নিত করা হয়েছে। একাডেমিক ও নন-একাডেমিক বিভিন্ন গবেষণায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে।

চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত (২৬ ডিসেম্বর) দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেটে এ তথ্য জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাড়াও স্কুল, কলেজ এমনকি মাদ্রাসার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীরাও এ সময়কালে আত্মহননের পথে হেটেছে। 

সবশেষ গত বুধবার (২২ ডিসেম্বর) রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি হওয়া মো. তৌসিফ নামে এক ছাত্রের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর আগে ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে ২৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। এর মধ্যে ১১ জনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

আরও পড়ুন: আত্মহত্যার মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ শিক্ষার্থী, ১১ জনই ঢাবির

সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ‘আত্মহত্যা এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা— করোনায় তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিপর্যয়’ বিষয়ক এক জরিপটিতে মোট ২ হাজার ২৬ জন তথ্য দিয়ে তাদের ভাবনা প্রকাশ করেছেন। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালীন সময় তরুণ-তরুণীদের মানসিক চাপ বৃদ্ধির সর্ব মোট হার ৬৩.৫ শতাংশ। মোট অংশগ্রহণকারী ২ হাজার ২৬ জনের মধ্যে ১ হাজার ২৩৯ জন তরুণ-তরুণী বলেছেন যে তারা করোনাকালীন সময় বিষণ্নতায় ভুগছেন যার হার ৬১.২ শতাংশ। এছাড়া জরিপে অংশ নেয়া ২১.৩ শতাংশ তরুণ তরুণীরা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছে। 

চলতি বছরের শুরুতে গত ২ জানুয়ারি পারিবারিক কলহের জেরে অভিমান করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাবিহা সুহা আত্মহত্যা করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়তেন।

আরও পড়ুন: করোনাকালে আত্মঘাতী ২১০ ছাত্রছাত্রী

২২ জানুয়ারি রাজশাহীতে ইকবাল জাফর শরীফ নামে ভারতীয় এক মেডিকেল ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। তিনি রাজশাহীর বেসরকারি বারিন্দ মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শরীফ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জের শ্মশানঘাট এলাকার মোজাম্মেল হোসেন পিন্টুর ছেলে।

গত ৩০ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী মির্জাপুর এলাকার একটি ছাত্রীনিবাস থেকে মোবাসসিরা তাহসিন ওরফে ইরা নামে এক ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আত্মহত্যার আগে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দেন তিনি।

আরও পড়ুন: করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলের ৪০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৌহিদুল আলম প্রত্যয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। 

ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের ২০ ব্যাচের ছাত্রী আফসানা আফরিন সুমি। ঘটনার দিন দুপুরে নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।

করোনার কারণে দেশে আসেন এশিয়ান প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির মালেশিয়া শাখায় পড়ালেখা করা ছাত্রী তাজরিন মোস্তফা মৌমিতা। থাকতেন পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সাততলা ভবনটির ছাদে ওঠেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পরিবার জানতে পারে, মৌমিতা ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন। তার মরদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা বলছেন, উঁচু ছাদ থেকে পড়ে মৌমিতার মৃত্যু হয়েছে। তবে মৌমিতার পরিবার তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করেন।

আরও পড়ুন: আত্মহননের মিছিল থামছেই না, আত্মঘাতী আরও ১১ শিক্ষার্থী

গত ৫ মার্চ নিজ বাড়িতে তিনি আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র নাইমুল হাসান। তিনি রসায়ন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের ছাত্র ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি সুইসাইড নোট লিখে গেছেন। চিরকুটে নাইমুল হাসান লিখেছেন, “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমার বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। আমার জন্য যদি কেউ কখনো কষ্ট পেয়ে থাকেন, পারলে মাফ করে দিয়েন।”

অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ২২ মার্চ ডা. লুৎফর রহমান নামে রাজশাহীতে এক চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। লুৎফর জেলার দুর্গাপুর উপজেলার ভবানিপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ৫৩তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে হেপাটোলজি বিষয়ে এমডি করছিলেন।

আরও পড়ুন: করোনাকালে ১৭ মাসে ২০০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা 

নিজ দেশে ফিরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত মোওসা আবু জামি এক ফিলিস্তিনি ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। তিনি কলেজের ২৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ১৩ এপ্রিল ফরিদপুর থেকে দেশে ফিরে যান আবু জামি। পরে ২৩ এপ্রিল ফিলিস্তিনের দূতাবাস থেকে ফোন করে কলেজের অধ্যক্ষকে তার আত্মহত্যার খবর নিশ্চিত করে।

বিয়ের দাবিতে ঢাকার আশুলিয়ায় প্রেমিকার বাড়িতে এসে বিষ পান করে গত ২৪ এপ্রিল আসাদুজ্জামান জলিল নামের এক ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার দিন দুপুরে আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকায় প্রেমিকার বাড়িতে বিয়ের দাবিতে এসে বিষপান করেন। পরে বিকেলে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

গত ৬ মে মধ্যরাতে নিজ বাসার পাশে আমগাছের ডালের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলমগীর কবির। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের ছাত্র ছিলেন। তার বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়।

আরও পড়ুন: ‘চুপচাপ’ তৌসিফ আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন

গত ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তার তিন বন্ধু এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন। সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘটনার দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে অজ্ঞাতনামা হিসেবে তার মৃত্যু হয়। পরে ২৩ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে হাফিজুরের ভাই তার লাশ শনাক্ত করেন।

আরও পড়ুন: হাবিপ্রবি শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

গত ১৯ মে মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের একটি বাসা থেকে মাহমুদুল হক নামে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির এক ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একটি ‘সুইসাইড নোট’ পাওয়া গেছে। তাতে লেখা ছিল, মানসিক যন্ত্রণা থেকেই আত্মহত্যা করেছেন তিনি। এর সূত্র ধরে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

প্রেমিকার সাথে মনোমালিন্যের জেরে ২০ জুন গলায় ফাঁস দিয়ে মোহাম্মদ সুজন নামে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। রাজধানীর বাড্ডার একটি বাসায় এই ঘটনা ঘটে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতকের শিক্ষার্থী ছিলেন।

৪ জুলাই চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আবিদ হাসান আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী ছিলেন। জিআরইতে তার স্কোর ছিল ৩১২ এবং ভালো কিছু পাবলিকেশনও ছিল। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে বিসিএস কিংবা সরাকারি চাকরির চাপ ছিল বলে সহপাঠীরা জানিয়েছেন। ফলে হতাশা থেকে আত্মহত্যা করতে পারেন বলে ধারণা সহপাঠীদের।

আরও পড়ুন: কুয়েট শিক্ষার্থীর ‘আত্মহত্যা’ 

২১ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের অনার্স ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষার ফলাফলে হয়েছে। ফলে অকৃতকার্য হয়ে মশিউর রহমান নামে এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। তিনি তার রুমে একটি সুইসাইড নোটে লিখেছেন, ‘হেরে গেলাম অবশেষে’।

মশিউরের গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদরে। গত ২৮ মে তিনি ঢাকায় আসেন। রবি সিম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি ইংরেজিতে অনার্সে পড়তেন বলে জানা গেছে।

গত ২৮ জুলাই অর্থাভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে ফারজানা বিন কাইয়ুম (২১) তরুণী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মৃত ফারজানা রাজধানীর সিটি কলেজে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়াশোনা করছিলেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মা ও ভাইয়ের মৃত্যু হয় মো. আলিফ নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর। এর জেরে গত ১ আগস্ট রাতে রাজধানীর গুলশান-২ এর সিকদার হাসপাতালের পাশের একটি সাত তলা ভবনের ছাদ থেকে তিনি লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। পুলিশ জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ওই শিক্ষার্থীর মা-ভাই মারা গেছেন। তাই ডিপ্রেশন থেকে এ ঘটনা ঘটতে পারে।

১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের নন্দনকানন এলাকা থেকে দিপিতা প্রাচী তিসি নামের এক ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার দিন বিকেলে নগারীর কোতোয়ালি থানাধীন নিজ বাসা থেকে ওই ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দিপিতা নগরীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রিমিয়ারের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

২৮ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার থেকে নিচে পড়ে আহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আকবর হোসেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ শিক্ষার্থীও প্রেমঘটিত কারণে মানসিক অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। তবে এটি আত্মহত্যা না পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সেটি জানা যায়নি। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পুলিশ তদন্ত করছে।

গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী মেসবাহ আত্মহত্যা করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছিলেন বলে জানান তার সহপাঠীরা।

১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বাড্ডায় ছাদ থেকে লাফিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চন্দন পার্সি নামে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনে না দেওয়ায় অভিমানে ২৪ সেপ্টেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমরুল কায়েস নামের এক ছাত্র। তিনি  বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী। 

সুইসাইড নোটে ‘বাবা-মা ক্ষমা করো, গুড বাই’ লিখে ২৩ সেপ্টেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে তাহমিদুর রহমান জামিল নামে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র আত্মহত্যা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন জামিল।

২৭ সেপ্টেম্বর মাসুদ আল মাহদী অপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের এক ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাজধানীর চানখারপুলের নাজিম উদ্দীন রোডের একটি ভবনে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে জানান পুলিশ।

৩০ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের সদর থেকে অমিতোষ হালদার নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ভোর ৫টায় জেলার সদর থানার পাটকেলবাড়ি ইউনিয়ন থেকে গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করা হয়। এ ব্যাপারে কয়েক পাতা সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে।

৭ অক্টোবর আত্মহত্যা করেছেন তানভীর আলম তুষার নামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। নিহত তানভীর বেবোবির অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে ফেসবুকে ‘আই কুইট ফর এভার’ লিখে একটি স্ট্যাটাস দেন তানভীর।

১০ অক্টোবর রাজধানীর একটি ছাত্রী হোস্টেল থেকে মাহফুজা আক্তার মুন্নি নামে নারী চিকিৎসকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে বর্তমানে একটি পোশাক কারখানায় চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি এফসিপিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

গত ২১ অক্টোবর নিজ কক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া মেহজাবিন স্বর্ণাকে উদ্ধার করা হয়। সহপাঠী ও পরিবারের দাবি, পড়াশোনার অতিরিক্ত মানসিক চাপে সে আত্মহত্যা করতে পারে।

২৮ অক্টোবর রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে আদনান সাকিব নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।

২৯ অক্টোবর বাথরুমে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন আবু জিহাদ মন্ডল নামে এক ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

১১ নভেম্বর রংপুর মেডিকেল কলেজের ডা. পিন্নু হোস্টেলের একটি কক্ষ থেকে মুশফিকুর রহমান নামে এক ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত মুশফিক রংপুর মেডিকেল কলেজের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

মহানগরীর খানজাহান আলী থানাধীন মাত্তমডাঙ্গা এলাকায় ১৭ নভেম্বর ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুব্রত কুমার। তিনি আর্কিটেকচার বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জয়ন্তী ছাত্রীনিবাস থেকে গত ১৮ নভেম্বর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্রী মাধবী রায় বর্মণের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। 

গত বুধবার (২২ ডিসেম্বর) রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি হওয়া মো. তৌসিফ নামে এক ছাত্রের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। তৌসিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন।

ঢাবি ছাত্রী মেঘলাকে হত্যা নাকি আত্মহত্যা?
গত ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের ছাত্রী মেঘলা চৌধুরী ইলমা মারা যান। তার পরিবার এটিকে হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছেন। অন্যদিকে মেঘলার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলছেন, এটি আত্মহত্যা। পরে এ ঘটনার মামলা করা হলে তার স্বামী ইফতেখার আবেদীনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তৃতীয় দফায় রিমান্ড শেষে গতকাল শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, করোনার সময়ে হঠাৎ করেই আত্মহত্যার হার বেড়েছিলো যা আমাদের গবেষণায়ও উঠে এসেছে। এই সময়ে দেশে প্রায় ১৪ হাজার ৪৩৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে যাদের মাঝে বৃহৎ অংশই ছিলো তরুণ-তরুণী। এই তরুণদের মাঝের অনেক বড় একটা অংশ ছিলো যারা পড়াশোনা করছে বা সম্প্রতি শেষ করেছে।

“শিক্ষার্থীরা কেনো আত্মহত্যা করে এটা খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, বড় একটা অংশই ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগেছে। দেখুন, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাকে জীবিকা নির্বাহের উপকরণ হিসেবে দেখে। সে যখন ভালো একটা জব খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে পড়ে তখনই সে আশাহত হয়ে যায় এবং আশাহীন জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এছাড়াও আমরা দেখি পরিবারের সাথে মনোমালিন্য, সমাজের অন্যদের সাথে নিজেকে তুলনা করে হীনমন্যতায় ভোগাও অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সংকটে ভুগে। খুব কম পরিবারই তাদের সন্তানের সব ধরনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। সবসময়ই একটা অদৃশ্য দেয়াল থাকে। এটা শুধু পরিবার নয় বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও একই রকম। একজন শিক্ষার্থী স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্রেশনে ভুগতে পারে সেটা আমাদের দেশের খুব কম শিক্ষকই বুঝতে পারেন।

তানসেন রোজ বলেন, হুট করেই একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যাপ্রবণ বা আত্মহত্যা করে না। অনেক দীর্ঘ সময় এবং অনেক গুলো ফ্যাক্টর তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণগুলো আমাদের কাছে ক্ষুদ্র মনে হতে পারে। এমনকি কিছু কিছু কারন হাস্যকরও লাগতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে হাস্যকর কারণগুলোর পেছনেও অনেক বড় কারণ লুকায়িত থাকতে পারে।

“যেমন একজন শিক্ষার্থীকে তার মা ভাত খেতে জোরাজুরি করায় আত্মহত্যা করে বসে। আমাদের কাছে কারণটা তুচ্ছ মনে হতে পারে। ভাত খেতে জোর করাটা হয়তো মূল কারণ না। বরং তার শরীর নিয়ে তার পাশের মানুষজন হয়তো বুলিং করতো আর ভাত খেতে জোর করাটা তাকে ট্রিগার্ড করেছে।”

তিনি বলেন, করোনা এখনো শেষ না হলেও আমাদের যেহেতু নিও নরমাল লাইফ শুরু হয়েছে তাই আমরা দেখছি শিক্ষার্থীদের মাঝে ডিপ্রেশন বা সুইসাইড বেশ উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন একটিভিটিতে জড়াচ্ছে, জবের সুযোগগুলোও বাড়ছে। পারিবারিক সমস্যাগুলোও কমা শুরু করেছে।

“আমাদের কাছে কাউন্সেলিংয়ের ক্লাইয়েন্টও আগের চেয়ে চল্লিশ শতাংশ কমেছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়। আমরা চাই না কোনো শিক্ষার্থীই আত্মহত্যা করুক। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একসাথে পদক্ষেপ নিতে পারলে আশা করি এই ভয়াবহ আত্মহত্যা মহামারী মোকাবেলা করা সম্ভব।”