করোনাকালেও থামছে না আত্মহত্যার মিছিল, নেপথ্যে বেকারত্ব-নিঃসঙ্গতা-প্রেম
- ইরফান এইচ সায়েম ও মোতাহের হোসেন
- প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২০, ০৭:৪৫ PM , আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২০, ১০:৫১ AM
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলতি বছরের ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এ সময়ে শিক্ষার্থীরা বাড়িতেই সময় কাটাচ্ছেন। দীর্ঘকাল লকডাউনের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মিছিল থামছেই না।
সর্বশেষ এ মিছিলে যুক্ত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ছাত্র ইমাম হোসাইন। আজ সোমবার সকালে বরিশাল জেলার উজিরপুর থানায় নিজ গ্রামের বাড়িতে তিনি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন।
যেসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে প্রতিবছর হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গ হয়, সেইসব স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে এসেও কেন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করবে? অপরাধ বিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। বেকারত্ব, পারিবারিক সমস্যা, প্রেমঘটিত জটিলতা, আর্থিক চাপ প্রভৃতি আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। তারা বলছেন, এসবের কোন একটি কারণে কেউ যখন নিঃসঙ্গ হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং এ হতাশার বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার করতে না পারে, তখন এ বিষয়টি আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। এ সমস্যা সমাধানে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবকে আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে বলে মত দেন তারা।
বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, নানা কারণে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছেন। এ থেকে বুঝা যায় সমাজের মধ্যে শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। এ সমস্যা কারও একার পক্ষে এটা দূর করা সম্ভব না। আমাদের আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে, তারপর বিষয়গুলো কমে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। এর পেছনে কাজ করছে প্রযুক্তির অগ্রসরতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব। ফলে তরুণ-তরুণীরা তাদের সমস্যার সমাধান হিসেবে আত্মহত্যাকে বেঁছে নিচ্ছে। এ ধরনের একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে প্রভাবিত করছে বলেও তিনি মনে করেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন বলেন, যিনি আত্মহত্যা করে থাকেন তার কিছুদিন আগে থেকে মানসিক স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এ সময় তার মানসিক সুস্থতা থাকে না। এ সময় তিনি নিঃসঙ্গতায় ভোগে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং এ হতাশার বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না তখন তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। তীব্র বিষন্নতা, তীব্র মানসিক চাপ, হতাশা এসব বিষয়গুলো তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। অনেক সময় দেখা যায়, যিনি আত্মহত্যা করে থাকেন, তিনি কারও থেকে যে যথাযথ সমর্থন দরকার, সেটা পান না। কোনো ধরনের সাহায্যে পান না।
জানা গেছে, ঢাবি ছাত্র ইমাম হোসাইনের সাথে রাজধানীর ইডেন কলেজের এক ছাত্রীর প্রেমের সর্ম্পক ছিল। তবে বিষয়টি ওই মেয়ের পরিবার মেনে না নেওয়াতে ইমামের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ইমাম মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল।
এদিকে, করোনার কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় ওই ছাত্র গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেছিল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন কবি জসীম উদদীন হলে। ঢাবির ওই ছাত্রের ফেসবুকের কাভার ফটো ছিল ‘তোমাকে পাবো পাবো বলেই আত্মহত্যার তারিখটা পিছিয়ে দেই।’ আর প্রোফাইলে ছিল- ‘সিলিংয়ে ঝুলে গেলো সত্তা, নাম দিলে তার আত্মহত্যা।’
চলতি মাসের ৬ তারিখে তোরাবি বিনতে হক নামে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি নেত্রকোনার চল্লিশা ইউনিয়নের মোগরাটিয়া গ্রামে।
জানা যায়, ঘটনার আগে লেখাপড়া সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে রাগারাগি হয় তোরাবির। পরে তিনি নিজ রুমের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন। দরজা বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যরা ডাকাডাকি করলেও কোনো সাড়া-শব্দ মেলেনি। পরে খবর দেওয়া হলে রুমের দরজা ভেঙে তোরাবির ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মায়ের সঙ্গে অভিমান করে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি মাসের ১ তারিখে সুপ্রিয়া দাস নামের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি গণিত বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টায় ফারিদপুরের নিজ বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন।
এর আগে চলতি বছরের ১৫ জুন সুপ্রিয়ার প্রেমিক তপু মজুমদার আত্মহত্যা করে। এর দেড় মাস পরে এই ঘটনা ঘটল। সুপ্রিয়া দাসের এক সহপাঠীরা জানান, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) প্রাক্তন ছাত্র তপু মজুমদারের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল সুপ্রিয়ার। দুজনের বাসা একই এলাকায়। উভয় পরিবার মেনে নিয়েছিল দুজনের সম্পর্ক। করোনার মধ্যেও সুপ্রিয়ার বাসায় এসেছিল তপু মজুমদার।
তিনি বলেন, গত ১৪ জুন রাতে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। কান্না করতে করতে সুপ্রিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় অনেক এসএমএস। তাৎক্ষণিক ফোন করে জানতে পারে তপু আত্মহত্যা করেছে। এরপরই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সুপ্রিয়া। তপু আত্মহত্যার জন্য সামাজিকভাবে তাকে দোষারোপসহ নানান কটূক্তি করা হয়। সামাজিক ও মানসিক চাপেই সুপ্রিয়া আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে বলে মনে করেন তার কাছের বন্ধুরা।
১৫ জুন রাজধানীর দারুস সালামের একটি বাসা থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের প্রভাষক তপু মজুমদারের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিন সকালে বসুপাড়া ই/৪ নম্বর সামছুল আরেফিনের বাসার দ্বিতীয় তলার দরজা ভেঙে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানান, সকালে খবর পেয়ে ওই বাসা থেকে এক শিক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ফ্যানের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলো মরদেহটি। তপু মজুমদারের বাবার নাম গৌরাঙ্গ মজুমদার। তার বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীতে। গাবতলীর ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক ছিলেন তপু মজুমদার। তিনি কিছুটা মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন।
জানা গেছে, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) প্রাক্তন এ শিক্ষার্থী পড়াশুনা শেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে শিক্ষকতা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি কুয়েটের ২০১৪ ব্যাচের সিভিল বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
গত ২০ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানবাজার এলাকায় নিজ বাসায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে নীলম ধর অর্পা (২৩) নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। অর্পা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে লোকপ্রশাসন থেকে মাস্টার্স পাশ করে বের হন। বর্তমানে তিনি সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
গত ১০ জুলাই পারিবারিক কলহের জেরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) সাদিয়া কুতুব নামের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। তিনি সমাজবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওইদিন দুপুরে গোপালগঞ্জে তাঁর নিজ বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মজনুর রশিদ বলেন, যতটুকু জানতে পেরেছি, সে পারিবারিক কলহের জেরেই আত্মহত্যা করেছে।
গত ১৪ আগস্ট টাঙ্গাইলে শহরের কোদালিয়ায় এলাকায় মারুফ (১৯) নামের এক কলেজ ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন। ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত মারুফ ওই এলাকার টেইলার্স ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে এবং এলেঙ্গা সরকারি শামছুল হক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, অন্যদিনের মত ১৪ আগস্ট রাতে মারুফ তার নিজের ঘরে ঘুমাতে যায়। রাতের কোন একসময় পাশের ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। শুক্রবার পরিবারের লোকজন মারুফকে ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখে দ্রুত উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে স্বজনরা তার মরদেহ বাসায় নিয়ে যান। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
টাঙ্গাইল সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন বলেন, মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ওই ছাত্র আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়।