মাদ্রাসার অধ্যক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি বহিষ্কৃত সহ-সমন্বয়কের, ফোনালাপ ভাইরাল

ওমর ফারুক শুভ
ওমর ফারুক শুভ  © টিডিসি সম্পাদিত

ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বহিষ্কার হওয়া সহ-সমন্বয়ক ওমর ফারুক শুভর বিরুদ্ধে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে। তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া ফেনী আলিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে পুনরায় পদে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে এই চাঁদা দাবি করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আজ মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) চাঁদা দাবির একটি কল রেকর্ড (ফোনালাপ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা ১৫ মিনিট ১২ সেকেন্ড দীর্ঘ। এটি ছড়িয়ে পড়ার পর ফেনীজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। 

ভাইরাল হওয়া ওই কল রেকর্ডে শোনা যায়, ওমর ফারুক শুভ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ও হামজা মাহবুবের কথা উল্লেখ করে অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। সেখানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ও ফেনীর সন্তান আজিজুর রহমান রিজভীর নাম উঠে আসে।

ভাইরাল হওয়া কল রেকর্ডে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথোপকথনে শুভ বলেন, 'আপনি (অধ্যক্ষ) আমার ওস্তাদ মানুষ, আমি আপনাকে কি বলবো। কোন মেয়ের গায়ে নাকি আপনি হাত দিয়েছেন। এটি সেন্ট্রালে অভিযোগ করা হয়েছে। সেন্ট্রাল থেকে আমাকে বলা হয়েছে। আজকেও রিজভী ভাই ফোন দিয়েছে। বলেছে, শুভ মিটিংয়ের পর তোমাকে আব্দুল কাদের আর হামজা ভাই কি বলছে তুমি তো দেখেছো? তুমি আব্দুল কাদের আর হামজা ভাইকে বলো আমরা একটা এমাউন্ট দিয়ে দিব, এগুলাে নিয়ে ওরা (কাদের ও হামজা) বিভিন্ন জায়গায় মতবিনিময় সভা করবে, ওখানে ভাড়ার জন্য ব্যবহার করবে। আজকেও আমাকে ফোন দিয়েছে, এজন্য আপনাকে ফোন দিয়েছি। এখন আপনি বলেন, আমি কি আপনাকে গত এক মাস কল দিয়েছি? দি নাই। আমার আগ্রহ ছিল না। এখন কেন দিয়েছি, তারা বলছে এজন্য দিয়েছি। আমি তো আর আমার পকেট থেকে দেওয়া সম্ভব না। আমি ১ হাজার, ২, ৪ ও ৫ হাজার টাকা দিতে পারবো। কিন্তু এক-দুই, পাঁচ লাখ টাকা তো আর দেওয়া সম্ভব না। 

শুভ বলেন, আপনি যাদের প্রিয় মনে করেন তারা আসলে আপনার প্রিয় না। আপনাকে আরও আপডেট জানাব। বেশিদিন না, সামনের মাসের (জানুয়ারি) ১৫ তারিখের আগেই সেরে ফেলব। আমি সব দিয়ে চেষ্টা করতেছি। সরাসরি কাউন্টার দিচ্ছি। আমি আলিয়াতে নিয়মিত ক্লাস করব। আপনিও আসবেন। আমি ট্রু শব্দ করলে সবাই বিড়ালের মতো চলে যাবে। মারা লাগবে না, চোখ রাঙালেই হবে। আমার সঙ্গে শুধু কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক না, ড. ইউনুসের সঙ্গেও হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। আমি একজন সমন্বয়ক। সেন্ট্রালে লিড দিয়ে থাকি। উপদেষ্টাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। আর আপনাকে যেটা বলছি, ওটা করলে করবেন, না করলে জানিয়ে দিবেন। কারণ আমি তাদের না করে দিতে হবে।

কথোপকথনে অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান পদ ফিরে পেতে কত টাকা লাগবে এমন প্রশ্ন করলে শুভ বলেন, হুজুর সে (রিজভী) আমারে বলেছে পাঁচ। আমি বলেছি, আস্তাগফিরুল্লাহ, হুজুরের মাসিক বেতনই ৩৫-৪০ হাজার টাকা। হুজুর এক বছরের বেতন দিলেও ৫ লাখ টাকা হবে না। তাছাড়া হুজুর গত দুই মাস অফিসও করতে পারছে না। বেতনও বন্ধ। আমারে কল দিয়ে বলেছে, ৫ লাখ নাও, হামজা-কাদেরকে পাঠাবো। 

অধ্যক্ষ কত লাগবে আবারও প্রশ্ন করলে শুভ বলেন, ৩ লাখ টাকা লাগবে বলেছে। সে (রিজভী) বলছে, এটা কাদের ভাই ও হামজা ভাইকে দিয়ে দিবে। তাহলে আপনার আর সমস্যা হবে না। হুজুর বুঝিয়েন, এরা সেন্ট্রাল সমন্বয়ক। আমি তো তাদের সাথে টকিং এ যেতে পারি না। আমি কিছু বললে আমাকেও বহিষ্কার করে দিবে, তখন আমি কিছু করতে পারব? কারণ এখন তাদের ক্ষমতা। আর আমারে যদি বহিষ্কার করে তাহলে আপনার প্রতি স্ট্রিমরোলার চলবে। আর সেন্ট্রালে যারা আছে তারা জামায়াত সমর্থিত। আর আমাদের নাহিদ ভাই (তথ্য উপদেষ্টা) বিএনপি করে। নাহিদের বাবা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে যুবদল করে। নাহিদের যে পিএস আছে সে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি আপনার জন্য নাহিদের সঙ্গে সর্বোচ্চ লবিং করতেছি। ওস্তাদ হিসেবে বলতেছি, আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আজিজুর রহমান রিজভী বলেন, ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভায় অংশ নিতে আসা কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের নিয়ে শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে সভা হয়েছিল। সেখানেই ওমর ফারুক শুভর সঙ্গে প্রথম ও শেষ দেখা হয়। পরবর্তী শুভ বিভিন্ন সময় আমাকে ফোনকলে, ম্যাসেজ দিয়ে ফেনীর কমিটিতে তার নাম উপরে দেওয়ার জন্য বলতেন। তার ধারণা ছিল আমিই কমিটি দেব। এছাড়া আমি সমন্বয়ক না, আন্দোলনও করেছি ঢাকায়। এ ফোনকলের বক্তব্যের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। 

এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হামজা মাহবুব বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। ফেনীতে আন্দোলনের পরবর্তী কোনো কমিটি নেই, তাই বর্তমান সমন্বয়কারীরাই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কমিটি না থাকায় অভিযুক্ত শুভর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা চলছে।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওমর ফারুক শুভ বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত অডিওটি সুপার এডিট করা হয়েছে। এটি আমার কণ্ঠ নয়। ফেনীতে আমি ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি, যা কিছু মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে হেয় করার জন্য এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। চাঁদাবাজির মতো ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

জানা যায়, গত ৩ অক্টোবর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার ড. মো. আবু হানিফা স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বিধি অনুযায়ী ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসককে বলা হয়েছে। একইদিন অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করে মাদ্রাসার শিক্ষক গাজী মীর ইকবাল হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়। তদন্তে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মেরও সত্যতা পাওয়া গেছে। 

এছাড়াও আওয়ামী সরকারের আমলে ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নানা অপকর্মের হোতা ছিলেন অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসান। সরকার পতনের পর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মাদ্রাসার শিক্ষিকা-ছাত্রী কেলেঙ্কারি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়ে মাদ্রাসায় তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের পর থেকে অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান এখনও পলাতক রয়েছেন।

এদিকে আগস্টে আন্দোলনে শৃঙ্খলা বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকায় ওমর ফারুক শুভকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফেনী জেলার সহ-সমন্বয়ক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরও বিগত কয়েক মাস ধরে জেলার অন্য সমন্বয়ক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে আগের পরিচয় দিয়েই শুভকে বিভিন্ন কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে।


সর্বশেষ সংবাদ