১৫০ জাহাজে প্রতিদিন ৩০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি

নগরবাড়ি ঘাটে নোঙরকৃত জাহাজগুলো
নগরবাড়ি ঘাটে নোঙরকৃত জাহাজগুলো  © টিডিসি ফটো

পাবনার নগরবাড়ি ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি বন্দরে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে ব্যাপক চাঁদাবাজি এবং ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এতে জাহাজ চালক ও শ্রমিকদের জীবনের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

এসব নৌপথে ১৫০টিরও বেশি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। যাত্রাপথে প্রতিটি পয়েন্টে জাহাজপ্রতি চাঁদা দিতে হয় ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা। একেকটি জাহাজকে গন্তব্যে পৌঁছাতে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর এসব পয়েন্টে প্রতিদিন ১৫০টি জাহাজ থেকে চাঁদা আদায় হয় অন্তত ৩০ লাখ টাকা। 

রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) পাবনার নগরবাড়ি নদীবন্দর সরেজমিন ঘুরে ভুক্তভোগী জাহাজ চালক ও শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য উঠে এসেছে। 

এ বিষয়ে জাবালে নুর জাহাজের মাস্টার তোরাব মোল্লা বলেন, কোটি কোটি টাকার পণ্য নিয়ে আমরা নৌপথে চলাচল করি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যাত্রা পথে চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন পয়েন্টে। মাঝে মধ্যে ডাকাতের কবলেও পড়তে হয়। কোনো নিরাপত্তা নাই। জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে চলি। এই যেমন গত শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে নারায়নগঞ্জের ধর্মগঞ্জে ঘাটে বেধে রাখা এমভি ওশান স্টার জাহাজে ডাকাতি হয়েছে। নগদ ৬০ হাজার টাকা ও ১৫টি মোবাইল নিয়ে গেছে ৷ 

জাবালে নুর জাহাজের চালক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘জাহাজ প্রতি ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে যার কাছে যেমন পারে চাঁদা নেয় নৌপুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে এসে তারা ডিউটির কথা বলে চাঁদাবাজি করে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের লোকজন এসব চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। চাঁদা না দিলে ডাকাতি করে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘তিন মাস আগে মেহেন্দিগঞ্জ মল্লিকপুর থেকে আমাদের এক শ্রমিককে অপহরণ করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে বিকাশে ২৭ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ওই শ্রমিককে মুক্ত করি। অথচ নৌপুলিশ বা কোস্টগার্ড আমাদের নিরাপত্তা দেয় না। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলাচল করি।’

নৌপথে এমন চাঁদাবাজির বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মাস্টার হারুন নেছা জাহাজের চালক কাজী আহম্মদ আলী বলেন, 'আমরা চাঁদাবাজির অভিযোগ দিয়ে কি করবো। অভিযোগ বা জিডি করলে প্রাণনাশের হুমকি থাকে। আমরা সারাদিন রাত জাহাজে কাটাই। অভিযোগ দেওয়ার সময় পাই না। চাঁদাবাজিই শুধু নয়, ডাকাতদল নিয়েও আমরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকি। চাঁদা না দিলে ডাকাতি করবে বলে হুমকি দেয়। আমার জীবনে তিনবার ডাকাতের কবলে পড়েছি। জাহাজে যার কাছে যা থাকে লুট করে নিয়ে যায়। নৌপুলিশ কোস্টগার্ড যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তারা তো নিরাপত্তা দিতে পারে না।'

এমভি মনসুর পরিবহনের মাস্টার নান্না ব্যাপারী বলেন, মংলা থেকে সার নিয়ে নগরবাড়ি আসছি। আসার পথে বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়ার নৌপুলিশ চাঁদা নিয়েছে এক হাজার টাকা। কাগজপত্র আমাদের থাক বা না থাক তাদের চাঁদা দিতে হবে এটা তাদের আইন। কিছু ঘাটে সরকারি চাঁদা নেয় রসিদ দিয়ে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো রসিদ দেওয়া হয় না। 

কারা নেয় চাঁদা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগের লোকজন, নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড চাঁদা নিয়েছে। এখন বিএনপির লোকজন নিচ্ছে। তাদের তো নাম পরিচয় জানি না। নদীর মধ্যে থাকি, তারা এসে নিয়ে যায়।'

এ বিষয়ে নগরবাড়ি নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আতিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলা নিষেধ আছে। তাই কথা বলতে পারছি না। আমাদের নৌপুলিশ রাজশাহীর মিডিয়া সেলের সাথে যোগাযোগ করুন।'

রাজশাহী নৌপুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সাদিকুর রহমান বলেন, ‘গত এক বছরের মধ্যে পাবনায় নৌপুলিশ কর্তৃক কোনো চাঁদাবাজি বা ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। এমন অভিযোগও আমরা পাইনি। যদি আপনাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানালে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরো জানান, ‘তবে দেড় বছর আগে নগরবাড়ি নৌপুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ (বর্তমানে নাজিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মকরত) শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে, আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।’

পাবনার নগরবাড়ি নৌ বন্দর কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াকিল বলেন, নগরবাড়ি নৌবন্দরে কোনো চাঁদাবাজির অভিযোগ নেই। আমরা এ বিষয়ে সবসময় তৎপর রয়েছি। নৌপুলিশ, স্থানীয় ব্যবসায়ী, শ্রমিক, জাহাজ চালক সবার সাথে কথা বলে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। এই নদীবন্দর ঘিরে কোনোরূপ অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। যদি কেউ অভিযোগ করেন তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


সর্বশেষ সংবাদ