ঢাবিতে চুরি-ছিনতাই বাড়ছে; নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা!
- নুর হোসেন ইমন
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০১:২৪ PM , আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৩:০৪ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাস্প্রতিক সময়ে বেড়েছে চুরি ও ছিনতাইয়ের মত ঘটনা। হলগুলোতে ঢুকে পড়ছে বহিরাগত চোর। এসব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাস ও এর আশপাশের এলাকাগুলো পরিণত হয় অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে। হরহামেশা এসব ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা নেই। কালেভাদ্রে দু’একটা ঘটনা সীমা ছাড়িয়ে গেলে তখনই কেবল দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অভিভাবকরাও।
অনিরাপদ আবাসিক হলসমূহ :
আবাসিক হলগুলোতে অব্যাহতভাবে বেড়েছে চুরির ঘটনা। সংঘবদ্ধ চক্রের অপতৎপরতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়মিত হারাতে হচ্ছে ল্যাপটপ, মোবাইল, টাকাসহ প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র। গণরুমগুলোতে এধরণের ঘটনা ঘটছে বেশি। ছাত্র হলগুলোতে নামমাত্র গেটম্যান বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে কোনরকম বাধা ছাড়াই বহিরাগতরা প্রবেশ করছে হলে। ছাত্রী হলেও নিয়মিত ঘটছে এসব ঘটনা। ছাত্র হলে ভোররাতে শিক্ষার্থীরা যখন ঘুমে থাকেন তখন বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে দামী জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। এমন কয়েকটি ঘটনায় কয়েকজন চোরকে ধরে পুলিশেও দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রী হলের মধ্যে কয়েকদিন আগে রোকেয়া হল থেকে এক বহিরাগত চোরকে ধরে পুলিশে দেন ছাত্রীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের দর্শন বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান হাসান বলেন, ‘‘প্রশাসনের উদাসীনতা ও একঘেয়েমির কারণে হলে প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটছে। এতে প্রতিনিয়তই শিক্ষার্থীদের মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হচ্ছে। মাঝে-মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে চোর ধরা পড়লেও অবস্থার আশানুরূপ সুরাহা হচ্ছে না। আবাসিক হলসমূহের প্রত্যেকটি ব্লক সিসিটিভি ক্যামরার আওতায় এনে নিরাপত্তা জোরদার করা যেতে পারে। কেবল মাত্র হল প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে এসব ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব।’’
গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নেই সিসিটিভি ক্যামরা :
বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, পলাশী, মল চত্বর, শ্যাডো, মধুর ক্যান্টিনসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নিয়মিত চুরি ছিনতাইয়ের মত ঘটনা ঘটলেও এসব জায়গায় নেই পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামরা। এ কারণে খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা অপরাধ করে পালিয়ে যায়, তাদের আটক বা শনাক্তও করা সম্ভব হয় না। দর্শন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও তরুণ কলাম লেখক জাহানুর ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় প্রতিনিয়ম চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবহুল জায়গাগুলোতে সিসিটিভি থাকা খুবই দরকারী। আমি মনে করি, এসব সমস্যার সমাধানে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
সন্ধ্যার পরের ক্যাম্পাস :
সন্ধ্যার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বর ও রাস্তাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে যায়। রাস্তায় আলো থাকার পরও ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। ক্যাম্পাসের বটতলা, মল চত্বর, শামসুন্নাহার হলের সামনের গেইট থেকে শুরু করে সর্বত্রই বেড়ে যায় অপরাধীদের আনাগোনা। এ সময়টাতে এসব জায়গায় অসামাজিক কার্যকালাপ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের চলাফেরার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। এসব অপকর্মকারীর ৮০ ভাগই বহিরাগত বলে মত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরহাম শুভ বলেন, “চুরি ও ছিনতাইয়ের মত ক্যাম্পাস এরিয়ায় সন্ধ্যার পর বহিরাগতরা অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে, এটাও শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রভাব ফেলছে। এদের মধ্যে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী খুবই হাতেগোনা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ছাত্ররাও এসবের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।”
অপরাধীদের কয়েকটি স্বর্গরাজ্য :
শাহবাগ থানার গোয়েন্দা কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণ ও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার বিশ্লেষণ অনুযায়ি-- পলাশী মোড়, দোয়েল চত্বর ছাড়াও জহুরুল হক, উপাচার্য ভবন, রোকেয়া হল, জগন্নাথ হল, কবি জসীম উদ্দীন হল ও বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তায় অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে বেশি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘেঁষা চারুকলা অনুষদ ও ক্যাম্পাস এলাকায় ভবঘুরে এবং মাদকসেবীদের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। চারুকলা অনুষদের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসের ভিতরে যারা মাদক সেবন করে তারা বেশির ভাগই বহিরাগত। ক্যাম্পাস ছুটি থাকলে এদের আনাগোনা আরও বাড়ে। এ এলাকায় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা নিয়মিত টহল না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এশিক্ষার্থী।
দৃশ্যমান তৎপরতা নেই কর্তৃপক্ষের :
নিয়মিতভাবে ক্যাম্পাসে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা নেই। গত ৩ নভেম্বর ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এর খোলা স্থানে মোটরবাইক রেখে ভবনটিতে প্রবেশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের (সাবেক) শিক্ষার্থী ও সময় টেলিভিশনের স্পোর্টস রিপোর্টার তারেক হাসান শিমুল। এর ২০ মিনিট পর ফিরে এসে দেখেন তার বাইক চুরি হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও তার বাইক উদ্ধার হয়নি। তারেক হাসান শিমুল এ বিষয়ে বলেন, “ব্যাক্তিগত কাজে আমি বাইক রেখে টিএসসির ভিতরে গেলে ২০ মিনিটের মধ্যেই সেট চুরি হয়ে যায়। প্রক্টর স্যারকে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি পুলিশের সহযোগিতায় চোরকে সনাক্ত করার আশ্বাস দেন। ওই এলাকায় কোন সিসিটিভি ক্যামরা না থাকায় থানায় জিডি করেও ফিরে বাইকটি পাইনি।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চারদিক থেকে খোলা। এ কারণে খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে ও অপরাধ করে দ্রুত পালিয়েও যায়। তাই তাদের সবসময় আটক করা ও শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানী বলেন, “সব ধরণের অপরাধমূলক কাজ ও অপতৎপরতা ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রক্টরিয়াল বডির সব সদস্যের সাথে নিয়োমিত আলাপ আলোচনা করে ও পরামর্শ নিয়ে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। আমাদের লোকবলেরও কিছু সংকট রয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে আলোর ব্যাবস্থা করা, নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোরদ্বার করা ও সিসিটিভি ক্যামরার আওতায় নিয়ে আসার কাজগুলো প্রতিনিয়ত চলছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। যেহেতু এই ক্যাম্পাসের রাস্তা ব্যবহার করে অনেকে চলাফেলা করেন, সে কারণে নিরাপত্তায় সবার সহযোগিতা দরকার।”