বিসিএসসহ সব সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা কেন ৩০ বছর?
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৪৩ PM , আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:১২ AM
বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সের কোন বয়সসীমা না থাকলেও বাংলাদেশে বয়স ৩০ বছর পেরিয়ে গেলে আর সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করার কোন সুযোগ থাকে না।
অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটা থেকে যারা সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেন তাদের জন্য বয়সসীমা ৩২ বছর। নার্সের চাকরির ক্ষেত্রে তা ৩৬ এবং বিভাগীয় প্রার্থীর কোটায় ৩৫ বছর।
এ নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের অনেকসময় হাপিত্যেশ করতে দেখা যায়। চাকরিপ্রার্থীদের একটি জনপ্রিয় দাবি হচ্ছে, সরকারি চাকরির জন্য সবার বয়সসীমা সর্বোচ্চ ৩৫ করা হোক। এ নিয়ে আন্দোলনও আছে। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ নামে একটি অধিকার বিষয়ক সংগঠন ২০১২ সাল থেকে এই দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
যদিও সরকার কখনো এই দাবিতে কান দেয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে আবেদনের জন্য বয়সসীমা বেঁধে দেয়া থাকবে কেন?
‘৩০’ বছরের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারি চাকরির বয়স নির্ধারণের বিষয়টি শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ভারত তথা উপনিবেশিক আমল থেকে।
বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে তখন চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল। তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৩ বছর।
এরপর যখন পাকিস্তান শাসনামল আসে, তখন এই বয়সসীমা বাড়িয়ে ২৫ বছর করা হয়। কারণ তখন ধরে নেয়া হয়েছিল যে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য যেসব যোগ্যতার দরকার হয় তার সবকিছু অর্জন করে ২৫ বছরের মধ্যে প্রস্তুত হওয়াটা কঠিন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর এই বয়স আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২৭ বছর করা হয়।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ওই সময়ের বাংলাদেশের অবস্থাটা ভিন্ন ছিল। যুদ্ধের কারণে ধরেই নেয়া হয়েছিল যে, শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে এক বছর হারিয়ে গেছে। আর এ কারণেই শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরিতে প্রবেশের সময় বেশি লাগবে বলে বয়স বাড়ানো হয়।
“মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা লেখাপড়ায় একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম, এক বছর তো বন্ধই ছিল সব ধরণের ক্লাস-পরীক্ষা।”
তিনি বলেন, তবে বয়স বাড়ানোর সেই সময়ে বলা হয়েছিল এবং ধরেই নেয়া হয়েছিল যে, সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করলে বয়স আবার ২৫ বছরে নামিয়ে নেয়া হবে।
তবে পরে আর সেটি করা হয়নি। উল্টো এই বয়সের সময়সীমায় আরো পরিবর্তন আসে ১৯৯১ সালে এইচ এম এরশাদের শাসনামলে। সেসময় নানা পক্ষের চাপের মুখে এই বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয় যেটি এখনো কার্যকর রয়েছে বলে জানান সাবেক এই আমলা।
সরকারি চাকরি কেন জনপ্রিয়?
সরকারি কর্ম কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বৈতরণী বিসিএস পরীক্ষার সর্বশেষ সংস্করণে ১ হাজার ৮১৪টি পদের জন্য আবেদন করেছেন চার লাখ ৩৫ হাজারের বেশি তরুণ-তরুণী।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের চাকরির বাজারের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়ার জনপ্রিয়তা সবচাইতে বেশি। সরকারি চাকরির জনপ্রিয়তার পেছনে নানা যুক্তি তুলে ধরেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এমন একজন নাহার প্রামাণিক।
তবে নাহার প্রামাণিক হচ্ছে সেই সব লাখ লাখ তরুণের একজন যারা সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০২০ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে এখন সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করছেন তিনি।
এরইমধ্যে দুটি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। আরেকটির প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, সরকারি চাকরি চাওয়াটার অন্যতম কারণ নিরাপত্তা। বেসরকারি চাকরির তুলনায় সরকারি চাকরিতে নিরাপত্তা বেশি বলে মনে করেন তিনি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চলমান করোনাভাইরাস মহামারির সময় বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের যে দুরবস্থা দেখা গেছে, সেই তুলনায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোন চিন্তাই করতে হয়নি।
তার মতে, সরকারি চাকরির মতো পেশাগত নিরাপত্তা আরো কোথাও নেই। আর সেজন্যই সরকারি চাকরির জন্যই চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। প্রামাণিক অবশ্য মনে করেন যে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোন বয়সসীমা থাকা উচিত নয়।
বিশ্বের অনেক দেশেই এই বয়সসীমা নেই উল্লেখ করে প্রামাণিক বলেন, বাংলাদেশে বয়সসীমার বাধাটি বৈষম্যেরই সামিল।
তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতেও সরকারি চাকরির বয়স সীমা ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি নেই।
এছাড়া বাংলাদেশে পড়াশোনা বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা উচ্চশিক্ষা শেষ করে বের হন তাদের এমনিতেই সেশন জটের কারণে ২৬-২৭ বছর লেগে যায়। সেক্ষেত্রে ৩০ বছরের বয়সসীমা তাদের জন্য অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় বৈষম্যমূলকই বটে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
৩০ কেন উপযুক্ত বয়স?
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয় বরং উপমহাদেশের নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি চাকরি মূলত কোন চুক্তি অনুযায়ী হয় না, একবার শুরু করলে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সেটা চালিয়ে যেতে হয়।
আর এজন্যই সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তরুণদের কাজে লাগাতে চায় কর্তৃপক্ষ। যাতে তাদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়। আর তাই আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, চাকরিতে প্রবেশের একটা মানসিক বয়সও রয়েছে।
সামরিক বাহিনীতে চাকরির ক্ষেত্রে যেমন শারীরিক সক্ষমতার বিষয় থাকে, বেসামরিক চাকরিতে সেটা না থাকলেও মানসিক সক্ষমতার বিষয়টিও জড়িত বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, চাকরিতে প্রবেশের পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় পিক-আপ (গ্রহণ) করা এবং সে অনুযায়ী সার্ভিস বা সেবাদান ঠিক রাখতে হলে একটা নির্দিষ্ট বয়স দরকার হয়। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিষয়টি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বলেও মনে করা হয়।
তিনি আরও বলেন, চাকরিতে কন্ট্রিবিউট করা বা অবদান রাখতে হলেও একটা নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ সে যাতে অবদান রাখতে পারে তার জন্যও পর্যাপ্ত সময় দরকার হয়।
বাংলাদেশে সাধারণ চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমানে অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। দেরীতে চাকরিতে প্রবেশ করলে অবদান রাখার সময়ও কমে আসে বলে মনে করেন তিনি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি তুলে ধরেন বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি বাংলাদেশে কর্ম কমিশন- বিসিএস এর আওতাধীন নিয়োগ পরীক্ষাসমূহের কথা।
তিনি বলেন, এই পরীক্ষার মাধ্যমে একজন চাকরিপ্রত্যাশীর সম্পূর্ণ নিয়োগ পেতে তিন থেকে চার বছর সময় লাগে।
৩০ বছর বয়সে কেউ এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে চাকরি শুরু করতে হলে তার বয়স অন্তত ৩৩-৩৪ বছর হয়ে যায়। ফলে তার অবদান রাখার সময়সীমা এমনিতেই কমে যায় বলে মনে করেন তিনি।
“২৫ বছর বয়সে একজন ঢুকলে তার পিক-আপ করার সক্ষমতা যত থাকবে, ৩৪ বছর বয়সী একজনের সেই সক্ষমতা তো আর একই হবে না, কমে আসবে বলে আমি মনে করি।” এসব বিষয় মাথায় রেখেই বয়স নির্ধারণ করা হয় বলে জানান সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা।
এছাড়াও আরো নানা কারণ রয়েছে বলে জানান আলী ইমাম মজুমদার। তার মতে, একজন ব্যক্তি ২৫ বছরে চাকরিতে প্রবেশ করলে সে অপেক্ষাকৃত তরুণ থাকে এবং প্রশিক্ষণসহ নানা ধরণের কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে তার কোন পিছুটান থাকে না।
কিন্তু বয়স বেশি হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে, অন্য চাকরির মতো পিছুটান তৈরি হয় যা নতুন চাকরি, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কর্মসূচীতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়া কর্মক্ষেত্রে যারা সহকর্মী হিসেবে কাজ করবেন সেখানেও, বয়সের পার্থক্য খুব বেশি যাতে না হয় বা একটা নির্দিষ্ট বয়সের ধারা বজায় রাখার প্রতিও নজর দেয়া হয়।
আলী ইমাম মজুমদারের মতে, চাকরির বয়স হয়তো কিছুটা বাড়ানোর সুযোগ আছে। তবে এই সুযোগটি দেয়া হলে আরেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ শিক্ষিত তরুণ চাকরির জন্য অপেক্ষা করে থাকে, এই বয়সসীমা আরো দুই-তিন বছর বাড়ানো হলে আরো বেশি সংখ্যক তরুণ অপেক্ষমাণ থাকবে।
দীর্ঘমেয়াদে গিয়ে এই পরিস্থিতি সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বা শিক্ষিত বেকার বাড়ার মতো এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর থেকে আরো না বাড়ানোর বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলে তখন ‘করুণ অবস্থা হবে’। তিনি তখন যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, “একটা কাজ করবার তো একটা সময় থাকে, একটা এনার্জি থাকে।”
কিন্তু ৩৫ বছরের পর চাকরির পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট, ট্রেনিং শেষ করে যোগ দিতে দিতে ৩৭ বছর লাগে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, “তখন তো বিয়ে-শাদি হবে, ছেলে-মেয়ে হবে, বউ সামলাতে হবে, ঘর সামলাতে হবে আর পরীক্ষা দিতে হবে। তখন তো আরো করুণ অবস্থা হবে!”
সূত্র: বিবিসি বাংলা