আর কত অপেক্ষা ৪০তম বিসিএসের ৬৩ শিক্ষানবিশ এএসপির?

বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি
বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি  © সংগৃহীত

গত ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদায় ৪০তম বিসিএসের (পুলিশ) ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও আচমকা সেটি স্থগিত হয়ে যায়। পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া শাখার এআইজির বরাত দিয়ে স্থগিত হওয়ার বিষয়ে অনিবার্য কারণের কথা উল্লেখ করা হলেও আড়ালে শিক্ষানবিশ এসব এএসপিদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে দেখতেই সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত হয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি এই সমাপনী কুচকাওয়াজটি গত ২৪ নভেম্বর আয়োজনের দিনক্ষণ ঠিক হলে অজানা কারণে এবারও সেটি পুনরায় স্থগিত হয়। তবে ঠিক কি কারণে পুনরায় কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হলো, সে ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর কিছু জানায়নি। যে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা চিঠিতে সই করেছেন, তারাও এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি।

পরপর দুবার সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত হওয়ার পর এখন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা ৬৩ জন এএসপির মনে। শিক্ষানবিশ এসব এএসপিরা জানান, এক অনিশ্চিত জীবনের গোলকধাঁধায় তারা দিন পার করছেন। আদৌ চাকরিতে যোগদান করা হবে কি কা! এমন প্রশ্নেই আটকে আছে তাদের জীবনের বৃত্ত। 

৬৩ জন এএসপির মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে দ্যা ডেইলি ক্যম্পাস। তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, এভাবে চলতে থাকলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাবেন তারা। তাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি চাকরি ছেড়ে প্রশাসন ক্যাডারে সেবা দিতে এসেছেন। কিন্তু আরও আগে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হয়নি। ‘যদি কেউ কোন অসদুপায় অবলম্বন করে এখানে আসেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া উচিত, কিন্তু ফেসবুকে স্ট্যাটাসের অভিযোগের ভিত্তিতে এভাবে আমাদেরকে রেখে দেওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাইনা।’ বলছিলেন ভুক্তভোগী এসব এএসপিরা।

তারা বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের প্রত্যেকের এলাকায় অনেক অনেক এজেন্সি থেকে ভেরিফিকেশন হয়েছে। এলাকায় গিয়ে রাস্তাঘাটে যাকে যেখানে পেয়েছে তার কাছ থেকেই আমাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছে। চা দোকানদার, রিকশা চালক, ধান বিক্রেতা এমনকি প্রতিবন্ধী, কাউকে বাদ রাখেনি। টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়ার মতো এবিলিটি আছে কি-না এমন অপ্রীতিকর প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। এসব নিয়ে কোন আপত্তি নাই। তবুও যদি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয়, কোন কষ্ট থাকবেনা।’

একজন শিক্ষানবিশ এএসপি বলেন, ‘গত এক বছরের বেশি সময় ঠিকমতো পরিবারকে দেখিনি। অনিশ্চিত গন্তব্যের ভাবনায় রাতে ঘুম হয় না। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার কারণে এখানে থেকে কারো সাথে যোগাযোগ করার উপায় নেই। আমরা দেশের আইনকে শ্রদ্ধা করেই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে চাই। কিন্তু এই অনিশ্চিত গন্তব্য খুব দ্রুতই জীবনটাকে ভীষণ্ণ করে তুলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের না আছে পরিবার, না আছে আত্মীয় স্বজন। পরিবারের বা নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলেও অ্যাকাডেমির আইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণার্থীদের গিয়ে দেখা করার কোন সুযোগ নেই। আমাদের নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত আসুক সেটাই চাই। কেউ দোষী হলে তাকে আইনের মুখোমুখি করা হোক। কিন্তু বিনা বিচারে সবাইকে সাজা ভোগ করানো হলে এটা দেশের ইতিহাসে নেতিবাচক অধ্যায় তৈরি করবে।’

জানা গেছে, ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর ৪০তম বিসিএস এর মাধ্যমে এডমিন ক্যাডার ২৪৪ জন, পুলিশ ৬৯ জন, পররাষ্ট্র ২৪ জন, কাস্টমস ৭২ জনসহ ২৬টি ক্যাডারের ১৯৬৩ জন অফিসার যোগদান করেন। সবাইকে একসাথে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে  ৬ মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষ করে নিজ নিজ ক্যাডারের বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্য স্ব স্ব বিভাগে ন্যস্ত করে কর্তৃপক্ষ। 

এছাড়াও ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর পুলিশ ক্যাডারের ৬৮ জন অফিসারকে (১ জন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকায় ট্রেনিং এ যেতে পারেনি) সারদায় এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। এরমধ্যে ৪১তম বিসিএস থেকে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ায় ৪ জন অফিসার চাকরি ছেড়ে চলে যান, ১ জন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ট্রেনিং থেকে ছিটকে পড়েন। 

সরকারি চাকরি বিধি চাকরি বিধি ২০১৮ অনুযায়ী আগামী ৫ ডিসেম্বর ৪০তম বিসিএস থেকে ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে যোগদানের দুই বছর পূর্ণ হওয়ায় তাদের চাকুরি স্থায়ী হতে যাচ্ছে। তবে ৪০তম বিসিএস এ ট্রেনিংরত বাকি ৬৩ জন এএসপি অজানা এক গন্তব্য আটকে আছেন পুলিশ একাডেমিতে। অনিশ্চিত যাত্রায় তাদের দূরাবস্থার শেষ নেই যেন কোনোভাবে।

এর আগে গত ২০ অক্টোবর সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার। সে সময় তিনি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘এই ৬৩ জন এএসপি হাসিনার আমলে নির্বাচিত হয়েছে। আর কত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিসিএস (পুলিশ)-এ নিয়োগ হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যক্তি আমার জায়গা থেকে তাই উক্ত প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী নই। তাদের ব্যাপারে তদন্ত হয়েছে কিনা!’

এই সমন্বয়ক আরও লেখেন, ‘পুলিশ বাহিনীর এখনো কোনো সংস্কার হয়নি। অপরাধীরা এখনো ধরা পড়েনি। তাই আমি শহিদের রক্তের সাথে বেইমানি করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বৈধতা দিতে পারি না।’ সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মারের এই ফেসবুক পোস্টের পরেই তোলপাড় শুরু হলে ১৯ অক্টোবর রাত ৯টার পর হঠাৎ অনিবার্য কারণবশত পাসিং আউট স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মারের সাথে কথা হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র নিয়োগের বিষয়টি পুনরায় তদন্ত করার জন্য তাদের পাসিং আউট প্যারেড স্থগিত করা হয়েছে। আমরা সবাই জানি, প্রশাসন ক্যাডারে যারা থাকবেন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোতে তাদের ভূমিকা অনেক বেশি। দীর্ঘ সময় তারা দেশকে সেবা দিবে। কাজেই আমাদের দাবি ছিল, তাদের নিয়োগ নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না থাকে।

ঠিক কীসের ভিত্তিতে ৬৩ জন এএসপিকে ছাত্রলীগের এজেন্ট হিসেবে অবিহিত করা হয়? জানতে চাইলে এই সমন্বয়ক বলেন, আমরা সবাইকে ছাত্রলীগ বলিনি। আমাদের কাছে অভিযোগ ছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। কাজেই নতুন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের একজন কর্মীও নিয়োগ পেয়ে স্বৈরাচার হাসিনার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করুক, আমরা কেউই সেটা চাই না। এই ৬৩ জনের মধ্যে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ১জন হতে পারে আবার ৭ থেকে ৮ জনও হতে পারে। এটা গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে প্রমাণ হবে।

আড়াই মাস পরেও ৪০তম বিসিএসের এসব এএসপিদের নিয়ে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তাদের পরিবার দুর্দশায় রয়েছে। এসব বিষয়ে আম্মারের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবার বিষয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার বক্তব্য হলো সরকার দ্রুত সময়ে তাদের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত জানাবে। কর্তৃপক্ষ সময় অতিবাহিত করুক সেটাও আমরা চাই না। আমরা ন্যায় বিচারের দাবি করেছি। আশা করছি দ্রুত সমাধান আসবে।

এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাকাডেমি সারদার প্রিন্সিপাল মো. মাসুদুর রহমান ভূঞার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচের ৬৩ জন সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি, শিক্ষানবিশ) বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে নবনিযুক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস এ দায়িত্ব থাকা এনামুল হক সাগরের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা ফোন রিসিভ করেননি।


সর্বশেষ সংবাদ