প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান তৈরিতে তলানিতে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে বিগত ৫ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি মাত্র ০.২ শতাংশ
বাংলাদেশে বিগত ৫ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি মাত্র ০.২ শতাংশ  © ফাইল ছবি

আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে বিশ্বে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আর বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য বলছে, দেশের শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচলের মূল আয়োজন পরিচালিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবিহীন অনানুষ্ঠানিক খাত থেকেই।

বর্তমানে বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক খাতের চাকরিতে আইনি সুরক্ষা পাওয়ার মতো সুযোগ এবং কোনো কাঠামোও বিদ্যমান নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তরুণদের সরকারি চাকরি নির্ভরতা এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটটির কারণে এমন সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ।

প্রথমত এখানে প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, এখানে ভালো বিনিয়োগ সৃষ্টি হয়নি এবং তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানের বৈচিত্র‌্য সৃষ্টি করা যায়নি—ফলে আমাদের তরুণরা জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নিমো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন, শিক্ষক, আইইআর, জবি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে চাকরির বাজারে কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখানে আইনি সুরক্ষা এবং কোনো ধরনের সুরক্ষা কাঠামোও নেই চাকুরেদের জন্য। ফলে দেশের তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরি নির্ভরতা মুখ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকলেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়াও একটি বড় সংকট তৈরি করেছে। এছাড়া নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটটির কারণে এমন সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কার। দেশটির মোট কর্মসংস্থানের ৯৬ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সুদান ও নাইজেরিয়া।

আরও পড়ুন: চাকরির বাজার নিয়ে তারুণ্যের হতাশার সঙ্গে ছিল ক্ষোভও

সুদানে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ ও নাইজেরিয়ায় ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমশক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে লাওস, জাম্বিয়া ও বলিভিয়া। দেশগুলোয় অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত রয়েছে মোট শ্রমশক্তির যথাক্রমে ৯০ দশমিক ৫, ৮৫ দশমিক ৬ ও ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ। 

বাংলাদেশের বিগত দুই শ্রমশক্তি জরিপ বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, দেশে বিগত পাঁচ বছরে দেশে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র দশমিক ২ শতাংশ। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে দেশে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০২২ সালে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। অপরদিকে এ সময়ে উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেড়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

দেশের শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচলের মূল আয়োজন পরিচালিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবিহীন অনানুষ্ঠানিক খাত থেকেই।

২০১৬-১৭ সালে উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশে। বিগত ৫ বছরে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ০.২ শতাংশ।

সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের এ ঝোঁকের প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে দেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের ৬০ দশমিক ৬ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্নদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতের হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনায় অনেক কম যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরিতেও আবেদন ও যোগদান করছেন তরুণরা।

আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষায় দেশের অর্থ ও মেধার অপচয়

বিগত বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ জন ওয়েম্যান নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। চতুর্থ শ্রেণির (১৯তম গ্রেড) ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এছাড়া রেললাইনের নাট-বল্টু টাইট দেয়াসহ ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও তারাই করে থাকেন।

সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ওয়েম্যান হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স পাস। তখন কায়িক পরিশ্রমনির্ভর পদটিতে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত ছিল এসএসসি বা সমমান।

শুধু রেলওয়ে নয়, একই ঘটনা ঘটছে এ ধরনের অন্যান্য সরকারি চাকরিতেও। আবেদনকারীরা বলছেন, বেসরকারি চাকরিতে অনিশ্চয়তার কারণেও তারা নিম্নপর্যায়ের পদে হলেও সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে চাচ্ছেন। তদের মতে, দেশের বেসরকারি বেশিরভাগ চাকরিতে নিশ্চয়তা না থাকা; নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট, পেনশনসহ অন্যান্য ভাতা এবং শ্রম আইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্যই সরকারি চাকরিতে বেশি আগ্রহ তরুণদের।

আরও পড়ুন: বেড়েছে শিক্ষার পরিমাণ, কমেছে গুণগত মান

আমাদের দেশে কৃষি এবং গার্মেন্ট নির্ভরতা থেকে বের হয়ে বিভিন্ন ধরনের ভারী শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো যেত জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হতো এবং নতুন নতুন ক্ষেত্র হতো।

প্রথমত এখানে প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, এখানে ভালো বিনিয়োগ সৃষ্টি হয়নি এবং তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানের বৈচিত্র‌্য সৃষ্টি করা যায়নি—ফলে আমাদের তরুণরা জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি বলে মত তার।

সমাধান হিসেবে তরুণ এ শিক্ষাবিদ মনে করেন, চাকুরিদাতারা নিয়োগের ক্ষেত্রে হার্ডস্কিলের পাশাপাশি যেসব স্কিলগুলো দেখেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা বাড়ানো। যোগাযোগ দক্ষতা এবং নেতৃত্বের বিকাশেও জোর দেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ