অমর একুশে গ্রন্থমেলা

সকালটা শিশুদের বিকালে জনস্রোত

গ্রন্থমেলায় এসে সেলফি তুলছেন একদল বইপ্রেমী
গ্রন্থমেলায় এসে সেলফি তুলছেন একদল বইপ্রেমী  © টিডিসি ফটো

ছুটির দিন মানে জমজমাট আর শিশুপ্রহর মানে শিশুদের কলতানে মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ। এ দৃশ্য নতুন নয় অমর একুশে গ্রন্থমেলার। তাও আবার মেলার দ্বিতীয় দিনের এ দৃশ্য। শনিবার মেলার দ্বিতীয় দিন বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত ছিল মেলার প্রথম শিশুপ্রহর। বেলা ১১টায় মেলার দুয়ার উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিভাকরা শিশুদের নিয়ে প্রবেশ করতে থাকেন।

মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে এবার শিশু চত্বরকে সাজানো হয়েছে বিচিত্র সাজে। অভিভাবকরা ছোটবেলা থেকেই তাদের শিশুদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে এদিন নিয়ে এসেছেন মেলায়। সিসিমপুরের হালুম, টুকটুকি আর ইকরি-মিকরিকে নিয়ে মাতামাতি ছিল শিশু প্রহরে। তারা নানা রকম অঙ্গভঙ্গি, নাচ-গান আর মজা করে আনন্দে মুখর করে তোলে শিশুদের। মেলায় শিশুদের বই কেনার ঝোঁকও ছিল চোখে পড়ার মতো।

এদিকে, বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত গ্রন্থমেলায় লোকসমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। ছুটির দিন হওয়ায় সব বয়সের মানুষ এদিন মেলায় ছুটে এসেছিলেন। এদিন মেলায় প্রবেশপথগুলোতে ছিল দর্শনার্থীদের দীর্ঘ সারি। তবে মেলার বাংলা একাডেমি অংশে অধিকাংশ স্টল নির্মাণের কাজ শেষ হলেও পুরোপুরি সাজানোর কাজ শেষ হয়নি। উদ্যান অংশে কয়েকটি স্টল পুরোপুরি বন্ধ দেখা যায়। তারপরও সব মিলিয়ে শনিবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা ছিল জমজমাট। এদিন মেলায় নতুন বই এসেছে ৮১টি।

বেলা ১২টার পর সিসিমপুরের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। তিনি বলেন, সিসিমপুর গত কয়েক বছর ধরে শিশুদের জন্য ভালো কাজ করছে। শিশুদের জন্য বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে মেলায় হাজির হয় সিসিমপুর।

সিসিমপুরের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম বলেন, আমরা ১৫ বছর ধরে বাচ্চাদের জন্য নানা রকমের বিষয় নিয়ে হাজির হয়েছি। বইয়ের মধ্যেও বৈচিত্র্য আছে। আমরা এমন বই তাদের হাতে তুলে দিয়েছি যেন তারা দক্ষতার সাথে জীবন শুরু করতে পারে। এজন্য আমরা বলি, পড়ি বই জানতে, জানতে বড় হই।

সাভার হাজী হাতেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক আব্দুল্লাহ এসেছেন মেয়ে অনন্যা তাসনীম পূর্ণতাকে নিয়ে। বিভিন্ন স্টল থেকে কিনছেন গোটা দশেক বই। তিনি বলেন, সময় পেলেই গ্রন্থমেলায় আসা হয়। মেয়ের জন্য ছবি ও গল্পের বই নিয়েছি।

বিকেলে বইপ্রেমীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ। দ্বিতীয় দিনে সর্বস্তরের লোকজনের ভিড় ছিল লক্ষ্যণীয়। তবে স্টল সাজানোয় ব্যস্ত সময় পার করেছে প্রকাশনাগুলো। বিকেল ২টার দিকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে লোকজন সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করেন। বিভিন্ন স্টলে ঘুরে বই দেখছেন, কেউ ক্যাটালগ সংগ্রহ করে পছন্দের লেখকদের বইয়ের খোঁজ করছেন। নিজেদের সাধ্যের মধ্যে হলে বই কিনে ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করছেন। কথাপ্রকাশ প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন বলেন, ছুটির দিন হওয়ায় অন্যান্যবারের চেয়ে লোকজনের উপস্থিতি বেশি। বিক্রিও মোটামুটি হচ্ছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, খ্যাতনামা প্রকাশনা স্টলগুলোতে ভিড় ছিল বেশি। ক্লাসিক্যাল লেখকদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকলেও এর পাশাপাশি নতুন লেখকদের বই সংগ্রহ করছেন বইপ্রেমীরা। এছাড়া বয়সভেদে বিভিন্নজন কিনছেন বিভিন্ন রকমের বই। বাংলা প্রকাশ থেকে ‘জ্যামিতির মজার জগৎ’ বই নিয়েছেন তানভীর চৌধুরী। মেয়ে তানিজনাকে তুলে দিয়ে বলেন, মেয়েটার গণিতের প্রতি ঝোঁক বেশি। যার কারণে এই বইটি পছন্দ হয়েছে। অবসর প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী সজীব বলেন, মেলার দ্বিতীয় দিনে লোক সমাগমী অনেক ভালো। তবে অনেকেই এখনো স্টল সাজাতে পারেনি। আশা করছি কালকের মধ্যে সবঠিক হয়ে যাবে।

গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চের আয়োজন: শনিবার বিকেল ৪টা গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বিজয়: ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক-গবেষক আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন লেখক-সাংবাদিক হারুন হাবীব, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এমরান কবির চৌধুরী এবং গবেষক মোফাকখারুল ইকবাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক।

প্রাবন্ধিক বলেন, ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার মানুষকে মুক্তি ও স্বাধীনতার দিশা দিয়েছে। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির লড়াই ক্রমশ পরিণত হয়েছে সায়ত্ত্বশাসন এবং স্বাধীনতামুখী অনিবার্য সংগ্রামে। এ অঞ্চলের চিন্তানায়ক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘ সংগ্রামের পরম্পরায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালিরা যে পথে নেমেছিল সে পথ ছিল বীরত্ব, ত্যাগ, সংগ্রাম ও বিজয়ের পথ। সে পথে শেষ গন্তব্যে পৌঁছেছি আমরা নয়মাসের দীর্ঘ সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ ও বিপুল বীরত্বের বিনিময়ে। তখন ১৬ ডিসেম্বরের শীতবিকেলের সূর্য পশ্চিম দিগন্তে লালিমা ছড়াচ্ছিল, সে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল রমনার সবুজ চত্বর-আর সেই লাল-সবুজের অপরূপ আলোয় আমাদের বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ যেন বাংলার ও বঙ্গবন্ধুর জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল।

আলোচকবৃন্দ বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মোহনায় পৌঁছুতে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত ভাষা-আন্দোলনবাহিত চেতনাই আমাদের ধারাবাহিকভাবে উপনীত করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের দুয়ারে। ভাষার সংগ্রাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে জাতিসত্তার আত্মপরিচয় অন্বেষণে। তবে এ পথের যাত্রা কুসমাস্তীর্ণ ছিল না মোটেও। নানামুখী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বায়ান্নকে সফল করে তুলেছে একাত্তরে।

সভাপতির বক্তব্যে আহমদ রফিক বলেন, ভাষার সংগ্রাম মূলত স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলন চেতনার যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছিল তারই বিচ্ছুরিত শিখায় আমরা আমাদের জাতিসত্ত্বার স্বরূপ আবিষ্কার করেছি এবং আঁধার রাতের পরিধি ভেঙে সম্ভব করেছি স্বাধীনতার সুবর্ণ সকাল।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি আসাদ মান্নান এবং কবি হালিম আজাদ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ইস্তেকবাল হোসেন এবং লায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। সংগীত পরিবেশন করেন তিমির নন্দী, শিবু রায়, রুমানা ইসলাম, আলম আরা মিনু, শ্যামা সরকার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন বিশ্বজিৎ সরকার (তবলা), রিচার্ড কিশোর (গীটার), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড) এবং মোঃ ফারুক (প্যাড)। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী রুমানা আহমেদ সোমা।

রবিবারের অনুষ্ঠানসূচি : রবিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সুবর্ণজয়ন্তী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন গোলাম কুদ্দুছ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন রামেন্দু মজুমদার, মাহফুজা খানম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং আতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।


সর্বশেষ সংবাদ