বুক রিভিউ: শওকত ওসমানের ‘জননী’

  © টিডিসি ফটো

বাংলা কথাশিল্পের আঙ্গিক ও বিষয়ের ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ধরা হয় ‘কল্লোল’ (১৯২৩) থেকেই। কল্লোলের যুগধর্ম শওকত ওসমানকে (১৯১৭-১৯৯৮) কতটা প্রভাবিত করেছিল, সুনির্দিষ্ট করে তা বলা মুশকিল। তবে গ্রামবাংলার তৃণমূলসংলগ্ন মানুষের প্রত্যক্ষ জীবন অভিজ্ঞতা তাঁর লেখা পাওয়া যায়। দরিদ্র্যের পাঁকচক্রে বিদীর্ণ মানুষের সামাজিক সত্তা, ব্যক্তির পর্যুদস্ত, বিপন্ন অস্তিত্ব শওকত ওসমানের লেখার শিল্প-প্রাণ হয়ে উঠেছে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, শওকত ওসমানের জীবন জিজ্ঞাসা, দার্শনিক কৌতুহল ও সমাজতাত্ত্বিক অন্বেষা অন্য মুসলামান বাঙালি লেখকদের মতো নয়। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সেক্যুলার মানস ও বিশ্লেষণী মনোদৃষ্টি তাঁর লেখাকে অনন্যতা দান করেছে। শওকত ওসমান হয়ে উঠেছেন অন্য মুসলমান বাঙালি লেখকদের থেকে আলাদা, মর্যাদাবান এক রূপদক্ষ কথাশিল্পী।

শওকত ওসমানের ‘জননী’ (২০১৫) উপন্যাসে আমরা সেই পরিচয় পাই। এ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র জননী দরিয়া বিবি। শওকত ওসমান দরিয়া বিবির দু’টি সত্তাকে শিল্পাবয়ব দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
১. মাতৃত্ব
২. নারীত্ব।

একই চরিত্র কিন্তু অভিন্ন দু’টি সত্তা। এ দু’টি সত্তার টানাপোড়েন, অন্তঃবাস্তবতা ও বহিঃবাস্তবতার অন্তর্দ্বন্দ্ব দরিয়াবিবিকে শুধু বিপর্যস্ত করেনি, আপন অস্তিত্ব বিলোপের দিকেও নিয়ে যায়।

উপন্যাসের মূল চরিত্র দরিয়াবিবি। তবে দরিয়াবিবির দ্বিতীয় স্বামী কিংবা পাঠকের সামনে হাজির করা একমাত্র স্বামী ও তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাসও কম আসেনি। এমনকি লেখক তার মূল উপন্যাস শুরুর পূর্বেই দরিয়াবিবির স্বামী পরিবারে অতীতের গৌরবান্বিত উপাখ্যানের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।

দরিয়াবিবির প্রথম স্বামী মারা গেলে মহেশডাঙ্গা গ্রামে খাঁ বাড়ির আজহার খাঁর সাথে তার বিয়ে হয়। আজহারের মূল পেশা ছিল রাজমিস্ত্রির। কিন্তু সে কৃষি কাজও করে। আর মাঝে মাঝে রাজমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি নিয়ে অধিকতর জীবীকার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয় কাউকে কোন কিছু না জানিয়েই। বেশ কিছু দিন নিরুদ্দেশ থাকার পর তিনি হয় নিজেই ফিরে আসেন, নয়তো তাকে দরিয়াবিরি অনুরোধে অন্যরা খুঁজে নিয়ে আসে।

দরিয়াবিবির আগরে স্বামীর ছেলে মোনাদির ওরফে মনু শিশু অবস্থা থেকেই তাদের চাচার সংসারে পালিত হয়। কিন্তু একটু বুঝমান হলে সে দরিয়াবিবির সংসারে চলে আসে। দরিয়াবিবির স্বামী মোনাদিরকে নিজ সন্তানের মতোই আদর যত্নে লালন পালন করেন। কিন্তু একদিন রাগের বসে আজহার তার সব সন্তানকেই বেদম মারপিট করেন। একই সাথে মোনাদিরকেও। এতে মোনাদির রাগ করে নিরুদ্দেশ হয়। তবে সে আবার ফিরে আসে। কিন্তু এমন এক সময় ফিরে আসে যখন তার সৎ পিতা আজহার ম্যালেরিয়া জ্বরে ইতোপূর্বেই মারা গেছে।

আজহারের মারা যাওয়ার পূর্ব থেকেই তার বাসায় যাতায়াত করেন তার ফুফাত ভাই ইয়াকুব। সে ধনবান কৃষক এবং একই সাথে একজন সফল ব্যবসায়ীও। তার টাকা পয়সা বেশুমার। তবে তার লিবিডো শক্তির প্রাবাল্য আছে। তার ঘরে দুই বউ। তৃতীয় বিয়ে করার চেষ্টা করলে আগের বউরা তাতে প্রবল আপত্তি করায় সে তা খান্ত দিয়েছিল। এর বাইরেও অনেক কারণ ছিল যাতে দরিয়াবিবির স্বামী আজহার তাকে পছন্দ করত না।

কিন্তু আহজার পছন্দ না করলেও ইয়াকুব তার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত আর দরিয়াবিবির সংসারের জন্য উদারহস্তে ব্যয় করত। সে যখন বাড়িতে আসে তখন এত বেশি জিনিসপত্র, মিষ্টান্ন, বাজারঘাট সাথে করে নিয়ে আসে যে দরিয়াবিবির বাচ্চারাও ইয়াকুবের আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করত। দরিয়াবিবিও এসব পছন্দ করতেন না। কিন্তু সংসারের টানাটুনা এবং তার স্বামীর অকাল প্রায়াণে তিনি এতটাই অসহায় হয়ে পড়েন যে ইয়াকুবের উপহার-দান গ্রহণ অস্বীকার করা তো দূরের কথা, এগুলো এক সময় তার বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

এক সময় প্রকারান্তরে দরিয়াবিবির সংসার ইয়াকুবেই চালাতে শুরু করে। সে তার পূর্বের স্বামীর পক্ষের সন্তান মোনাদিরের পড়ার খরচও দিতে থাকে। দরিয়াবিবির স্বামী মারা যাওয়ার পর দরিয়া যেমন ইয়াকুবের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তেমনি লম্পট ইয়াকুবও দরিয়ার শরীরের প্রতি লোভাতুর হয়ে পড়ে। একদিন বিকেল বেলা দরিয়াবিবি যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছিলেন, তখন ইয়াকুব তাকে জড়িয়ে ধরেন। দরিয়া জেগে উঠলেও তার আর করার কিছু ছিল না। লম্পট ইয়াকুব তার আদীম ক্ষুধা মিটিয়ে সরে পড়েন। কিন্তু এই একদিনের সহবাসেই যে দরিয়াবিবির জীবনের অন্তিম সময় ত্বরান্বিত করবে তা কে ভেবেছিল?

এরপরও ইয়াকুব দরিয়াবিবির বাড়িতে আসে। নিয়মিতই দরিয়াবিবি তার আদর-আপ্যায়ন করেন। এক রাতে দরিয়াবিবি ঘরের বাইরে বের হলে লম্পট ইয়াকুব আঙ্গিনার কাঁঠাল গাছের নিচে এসে তার সাথে মিলিত হতে চায়। কিন্তু এ সময় তার বড় ছেলে মোনাদির বিষয়টি টের পেলে তাদের মিলন হয় না। মোনাদির বুঝতে পারে যে দরিয়াবিবি ইয়াকুবের সাথে অবৈধকর্মে লিপ্ত হওয়ার পথে ছিল। কারণ সেও এখন বড় হয়েছে। তবে সে বিষয়টিকে চোরের উপস্থিতি বলেই উড়ে দেয়। বিষয়টি যে মোনাদির ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল তা বোঝা যায় পরদিন অতিপ্রত্যূষে মোনাদির সবার অজান্তেই আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আবার পরদদিন সকালে চলে যায় ইয়াকুবও।

এর পর দরিয়াবিবির শরীরে বাড়তে থাকে ইয়াকুবের সন্তান। কিন্তু চতুর দরিয়া তা কাউকে বুঝতে দেন না। তিনি তার তলপেটের স্ফিতি যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য গোটা শরীরে অতিরিক্ত কাপড় জড়িয়ে এমনভাবে মোটা হয়ে থাকতেন যাতে সবাই মনে করত দরিয়াবিবি কেবল মোটাই হচ্ছে কিন্তু গর্ভবতী নয়।

কিন্তু বিষয়টি তো আর সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখা যায় না। বিশেষ করে নিজের কাছ থেকে। দ্রুতই সন্তান প্রসবের সময় উপনীত হয়। দরিয়াবিবি বুঝতে পারেন যে আজ রাতেই তার গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। তাই তিনি তার তিন সন্তানকে সারাদিন ঘুমাতে দেননি যাতে তারা খুব ক্লান্ত হয়ে দ্রুত গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে এবং সন্তান প্রসবের সময় কেউ জেগে না ওঠে।

সবাইকে ঘুম দিয়ে ঘরগুলোকে বাইরে থেকে আটকে রেখে দরিয়াবিবি তার রান্না ঘরে প্রবেশ করেন। এরপর একাই তিনি সন্তান প্রসবের জন্য তৈরি হন। ভূমিষ্ঠ সন্তানের যাতে কোন কষ্ট না হয়, কিংবা কেঁদে উঠে বিড়ম্বনার সৃষ্টি না করে তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন দরিয়া। এরপর নিজেই প্রসূতি ও নিজেই ধাত্রীর ভূমিকা নিয়ে তিনি নিরবে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।

এ স্থানে পাঠক একটু বিভ্রান্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে পাঠকগণ ধরে নিবেন যে দরিয়া বেগম তার অবৈধ সন্তানকে হত্যা করে নিজের জীবনকে কুসুমাস্তীর্ণ করবেন । কিন্তু না! সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে দরিয়া বেগম তার সঠিক যত্ন করেন। একজন প্রকৃত মায়ের এই অবৈধ সন্তানের প্রতি কি মমতা তার বর্ণনাটুকু লেখকের ভাষাতেই শোনা যাক:

দারিয়াবিবি প্রথমে শিশুকে বুকে তুলিয়া লইল। হয়তো তাকে বুকে চাপিয়াই বসিয়া থাকত। শিশুর চিৎকারে খেয়াল হয়। এই সাধানবাণীর জন্য দরিয়াবিবি বড় কৃতজ্ঞ-সজল চোখে শিশুর দিকে তাকাইল; তারপর গামলায় গোসলের সব খুঁটিনাটি সম্পন্ন করিল। অতঃপর শয্যার ব্যবস্থা। কয়েকটি রঙীন কাঁথা দরিয়াবিবি বিছাইল ও দুইটি কাঁথা মুড়িয়া নবজাতককে শোয়াইয়া দিল। সে নিজে তখনও দিগ্বসনা। তাড়াতাড়ি নিজে পরিষ্কার হইয়া তার নবতম অতিথিকে মাই খুলিয়া দিল। কি সুন্দর চুকচুক শব্দ হয়। কি মোটা তাজা গৌর রং শিশু। দরিয়াবিবি উম দিতে থাকে। শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ কয়েকবিন্দু অশ্রু পড়িল অলক্ষিতে।

এরপর দরিয়াবিবি ফাঁসিতে লটকে আত্মহত্যা করেন। পরদিন বিষয়টি জানাজানি হলে নিঃসন্তান হাসুবিবি সেই সন্তানকে কোলে তুলে নেয়। প্রতিপালন করে।

আমি এখন পর্যন্ত জননী বা মা শিরোনামের তিনটি উপন্যাস পড়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কির মা হল একজন আদর্শিক মা যিনি তার সন্তানকে কমিউনিজমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে প্রেরণা যোগায়। তিনি ক্রমান্বয়ে একজনের মা থেকে সব বিপ্লবীদের মা হয়ে ওঠেন। তাই এই মা আসলে রক্তমাংসের মা নয়।

পার্ল এস বাক এর মা অনেকটাই রক্তমাংসের। সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন। কিন্তু তার ভিতর মানবিক গুণাবলীর সবই বিদ্যমান। তিনিও জমিদাররূপী লম্পটের পাল্লায় পড়েন। তবে মানবিক কামনায় তিনি অবৈধ গর্ভধারণে নিজের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করেন। পরে তার গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তিনি তাকে মেরে ফেলেন কিংবা পরিত্যাগ করেন (অনেক আগে পড়েছিলাম,মনে নেই)। চাইনিজ সমাজের পটভূমিতে রচিত এই কাহিনীর মা তাই সর্বক্ষেত্রে মা হযে উঠতে পারেননি। তিনি জীবীত সন্তানদের জন্য হাজারও ত্যাগ স্বীকার করলেও অবৈধ সন্তানটির প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। তথা পার্ল এস বাকের জননী সব সন্তানের জননী হযে উঠতে পারেননি।

কিন্তু শওকত ওসমানের এ জননী একজন পরিপূর্ণ জননী। তার কাছে কোন সন্তানই অবহেলার নয়। জীবীত বা বৈধ সন্তানদের জন্য তিনি অমানবিক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পূর্বের স্বামীর ঘরের সন্তানের জন্য তার অন্তরের টান হয়েতো একটু বেশিই ছিল। এটা হয়তো সেই সন্তানটির বঞ্চনার জন্যই। কিন্তু তার গর্ভজাত সর্বশেষ সন্তানটি অবৈধ হলেও এবং তার ইচ্ছার বাইরে গর্ভে এলেও তার জন্য এ মায়ের মায়ার অভাব পড়েনি। তিনি একজন রক্তমাংসের মায়ের মতই সব কষ্ট স্বীকার করেছেন।তার সন্তানকে এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মতো সব ধরনের ব্যবস্থা করেই নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। তাই জননী চরিত্রের জন্মদাতা উপন্যাসিকদের মধ্যে আমার কাছে শওকত ওসমানকেই সবচেয়ে বেশি মানবিক বলে মনে হয়েছে।

তবে শওকত ওসমানের জননী শুধু একজন মায়ের মহত্বের কাহিনীই নয়, এ উপন্যাসে সমকালীন হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিরোধ, মধ্যবিত্ব ও প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-কষ্ট, মানুষের বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষের অন্তরের স্বাভাবিক স্বাধীকার চেতনা কিংবা গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে শহুরে অর্থনীতির স্ফিতিও সমান তালে স্থান পেয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি তিনি তার আজহার, দরিয়াবিবি, চন্দ্র কোটাল, এলোকেশী, শৈরমী, চন্দ্রমনী প্রমুখ চরিত্রের মাধ্যমে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে এটা যে কোন বর্ণনার আদর্শ হতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ