মুক্তিযুদ্ধে শহীদের অমলিন স্মৃতি বাকৃবির ‘মরণ সাগর’

বাকৃবির মরণ সাগর
বাকৃবির মরণ সাগর  © সংগৃহীত

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কিছু সূর্য সন্তানেরও। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য তাদের স্মৃতি রক্ষার্থেই নির্মিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ’ বা ‘মরণ সাগর’।

স্মৃতিস্তম্ভটিতে একটি সম্পূর্ণ পরিস্ফুটিত শাপলা ফুলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আছে দুটি হাত। হাতের মধ্যে একটি রাইফেল উঁচু করে ধরা এবং রাইফেলের অগ্রভাগে বাংলাদেশের পতাকা বাধা। যা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

স্মৃতিস্তম্ভটির দেয়ালে খোদাই করে লেখা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বাকৃবির ১৯ জন শহীদের নাম। মরণ সাগরের লাল রঙের সিঁড়ি ও মেঝে দ্বারা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়েছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় মরণ সাগর। যা পরবর্তীতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবরের (২০১৫-২০১৯ সময়কাল) পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মুক্তিযুদ্ধ স্থাপনা সংস্কার সম্পর্কিত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে বর্তমান রূপে নিয়ে আসা হয়।

স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজ থেকে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ঘোষণা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে এই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)।

 বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে নানা আয়োজন 

একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েতে উপস্থিত হন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. কিউএম ফজলুর রহিম ওই সভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন ‘আজ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং ’৫৪-এর একুশ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায় বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বাকৃবির রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

বাকৃবি থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদদের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলেই রয়েছেন। শিক্ষকদের (১ জন) মধ্যে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক এ.বি.এম আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া। কর্মচারীদের (৬ জন) মধ্যে মো. আক্কাছ আলী, মধুসূদন বর্মন, মো. নুরুল হক, মো. গাজী ওয়াহিদুজ্জামান, মো. হাসান আলী ও গিয়াস উদ্দিন।

ছাত্রদের (১২ জন) মধ্যে- মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের মো. জামাল হোসেন, আব্দুল মতিন খন্দকার (টিপু) ও মনিরুল ইসলাম আকন্দ; কৃষি প্রকৌশল অনুষদের নাজির আখতার কাশেম ও আ.ন.ম নাজমুল আহসান; কৃষি অনুষদের হাবিবুর রহমান ও খুরশীদ আলম (শিবলী); ভেটেরিনারি অনুষদের আবুল কাশেম, কাজী মো. মঞ্জুর হোসেন ও ইব্রাহীম মোস্তফা কামাল; কৃষি অর্থনীতি অনুষদের মো. শামসুল হক তালুকদার ও মো. তহসীন আলী।

শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে বাকৃবিতে ছাত্রদের জন্য নির্মিত ৩টি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে। মো. জামাল হোসেনের স্মরণে ১৯৮৮ সালের ১৩ অক্টোবর নির্মিত হয় শহীদ জামাল হোসেন হল। আ.ন.ম নাজমুল আহসানের স্মরণে ১৯৭৩ সালের ২৪ নভেম্বর নির্মিত হয় শহীদ নাজমুল আহসান হল। মো. শামসুল হক তালুকদারের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের সভায় পূর্বের কায়েদে আযম হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদ শামসুল হক হল।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দেশ সেরা এই কৃষি শিক্ষার বিদ্যাপীঠে হাজার হাজার আগন্তুকদের মাঝে যুগের পর যুগ দেশ স্বাধীন করার কারিগরদের স্মৃতি প্রতিফলিত করবে মরণ সাগর। ধ্বনিত হবে– ‘মরণ সাগর পারে, তোমরা অমর, তোমাদের স্মরি’।


সর্বশেষ সংবাদ