দেয়ালচিত্র ও লিখনে তারুণ্যের প্রতিবাদের অন্য ভাষা
- নুর হোসেন ইমন, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:৪২ PM , আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:১৬ PM
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন আলোচিত ইস্যু নিয়ে তরুণ সমাজ শুধু রাজপথে নেমে আন্দোলন-সংগ্রাম করে ক্ষান্ত হননি। এসব ইস্যুকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে সরব ছিল তারা। কখনও তারা প্রতিবাদ করেছে মিছিলের স্লোগানে, কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখনীর মাধ্যমে।
এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের প্রতিবাদের অন্য ভাষাও দেখা গেছে। দেয়ালে লিখন ও ‘গ্রাফিতি’-তে কখনও সিরিয়াস, কখনও রম্য ঢঙে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁদের বক্তব্য । রাজধানী ঢাকা শহরে বিশেষে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে চোখে পড়ে তারুণ্যের প্রতিবাদের অন্য এ ভাষা, দেয়ালে লিখন বা ‘গ্রাফিতি’।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেয়ালে লিখন বা ‘গ্রাফিতি’ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘদীনের ঐতিহ্য। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ এবং সরকার ও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন অন্যয়ের বিরুদ্ধে এ ধরণের কর্মকান্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তারা মনে করছেন, যখন কেউ অধিকার নিয়ে রাজপথ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বলতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে, তখন দেয়াল লিখনির মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ছাত্র আন্দোলন যেমন-কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ঢাবির ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁস ইস্যু প্রভৃতিতে আন্দোলনের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। এটি তাদের আন্দোলনে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
ঢাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘দেয়ালে লিখন হচ্ছে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘদীনের ঐতিহ্য। বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং সরকার ও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন অন্যয়ের বিরুদ্ধে এ ধরণের প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা সমর্থন করছি। তবে প্রতিবাদের ভাষা সুন্দর ও গঠনমূলক হওয়া উচিত বলে মনে করছি।’
ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, ‘বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের সক্রিয়তা বজায় রাখতে ও দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারছে। দাবি প্রকাশের এমন ভাষা অনেকেই ব্যবহার করে থাকে। তবে তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে যেন এসবের মাধ্যমে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন না করা।’
কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘যখন শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার নিয়ে মিডিয়া, রাজপথ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, এর পাশাপাশি সরকারি ছাত্র সংগঠন যখন শিক্ষার্থীদের মারধর-হুমকি দিচ্ছে তখন শিক্ষার্থীরা দেয়াল লিখনির মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ‘গত একযুগ ধরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের যেভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত করেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে তারা তাদের খোয়াড়ে পরিণত করেছে। ইদানিংকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন দেয়ালে যে লেখনী ও গ্রাফিতি আঁকা হচ্ছে তা হলো সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নির্যাতন,নিপীড়ন ও দমনের প্রতিবাদের এক সৃষ্টিশীল ও ব্যতিক্রমী মাধ্যম।’
ঢাবির মুহসীন হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এখন আগের মতো জ্ঞানচর্চার জায়গায় নেই। এখন রাজনীতির চর্চাটাই বেশি। আর রাজনীতি করতে গিয়েই ছাত্র কিংবা শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তোষামোদী চর্চা বেড়ে গেছে। তোষামোদির চর্চা করতে করতে এখন এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে এ ধরণের প্রতিবাদ খুবই ইতিবাচক।’
চিত্র সমালোচক বিশিষ্টজনেরা বলছেন, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোতে এ ধরণের প্রতিবাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও বাংলাদেশ আগে এর তেমন ব্যবহার দেখা যায়নি। এই শিল্পকর্মগুলোর মূল উপজীব্য সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ঘটনা। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভেতর দিয়ে কখনো এগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, প্রচলিত নীতি কিংবা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শৈল্পিক রূপ হিসেবে। কখনো হয়ে ওঠে নাগরিক অধিকার আদায়ের হাতিয়ার।