মুমতাহিনা করিম মীম © সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের হেনড্রিক্স কলেজের মর্যাদাপূর্ণ ‘হেইজ মেমোরিয়াল স্কলারশিপ’ পেয়েছেন বাংলাদেশের মুমতাহিনা করিম মীম। প্রতিবছর মাত্র চারজন শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় এই সম্পূর্ণ খরচ বহনের (ফুল রাইড) বৃত্তি। এবারের চারজনের মধ্যে তিনজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, আর একমাত্র আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে স্থান পেয়েছেন মুমতাহিনা।
এই বৃত্তির আওতায় চার বছরের টিউশন ফি, থাকা-খাওয়াসহ সব খরচ বহন করবে কলেজ কর্তৃপক্ষ। মুমতাহিনা জানিয়েছেন, চার বছরে তার বৃত্তির আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
গত ৫ আগস্ট মুমতাহিনা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন। হেনড্রিক্স কলেজে তার ক্লাস শুরু হয়েছে গত ২৬ আগস্ট থেকে। তিনি বর্তমানে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে-পরে হোয়াটসঅ্যাপে আলাপচারিতায় মুমতাহিনা জানান, এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন শুরু করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছিলেন ‘অফার লেটার’। এতগুলো সুযোগ থেকে বাছাই করা ছিল কঠিন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেনড্রিক্স কলেজকেই বেছে নেন। তাঁর কথায়, “গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমি বৃত্তি পাওয়া চারজনের একজন।”
মুমতাহিনার জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটায়, তবে বেড়ে ওঠা নগর চট্টগ্রামে। অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি।
তার বাবা আব্দুল করিম চৌধুরী ব্যবসায়ী, মা ইয়াসমিন আকতার গৃহিণী। ছোট ভাই আবদুল্লাহ সাদ বর্তমানে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে।
স্কুল-কলেজে সব সময় রোল ১০-এর মধ্যে ছিলেন মুমতাহিনা। পড়াশোনার পাশাপাশি সক্রিয় ছিলেন বিতর্ক, সাহিত্য, সংগীত, আঁকাআঁকি ও কোডিংয়ে। এসব কর্মকাণ্ড তাঁকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির আবেদনে বিশেষ সুবিধা এনে দেয়।
হেনড্রিক্স কলেজের বৃত্তি নির্বাচনে শুধু একাডেমিক সাফল্য নয়, ভাষাগত দক্ষতা, নেতৃত্ব এবং এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমকে বড় করে দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে মুমতাহিনা ছিলেন উজ্জ্বল প্রার্থী।
মুমতাহিনার প্রযুক্তিপ্রেমের সূচনা হয়েছিল মায়ের হাত ধরেই। ইয়াসমিন আকতার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে এমবিএ করেছেন এবং একসময় ফ্রিল্যান্সিং করতেন। সেখান থেকেই মেয়ে প্রযুক্তি ও কোডিংয়ের প্রতি অনুপ্রাণিত হন।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মা-ই তাকে ইউটিউবের কোডিং টিউটোরিয়াল দেন। নিজের প্রথম প্রোগ্রাম ‘Hello World’ লিখেই মুগ্ধ হন। সপ্তম শ্রেণিতে তৈরি করেন স্কুলের ওয়েবসাইট, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ায়।
নবম শ্রেণিতে প্রতিষ্ঠা করেন স্কুলের প্রোগ্রামিং ক্লাব। তার নেতৃত্বে দলটি জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে। করোনাকালে নিজ উদ্যোগে ইউটিউব দেখে নানান প্রজেক্টে কাজ করেন। নিজের সঞ্চিত অর্থে কেনেন আরডুইনো কিট ও সেন্সর, ঘরে বানান ছোট্ট ‘মিনি রোবোটিকস ল্যাব’। সেখানেই তৈরি করেন খাবার পরিবেশনকারী রোবট ‘কিবো’।
শৈশব থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি আকর্ষণ ছিল তার। নিজের ঘরের দেয়াল ছিল তার আঁকিবুঁকির ক্যানভাস। যদিও নিয়মকানুন মেনে আর্ট স্কুলে মন টেকেনি, ঘরে নিজের স্টুডিও বানিয়ে আঁকাআঁকি চালিয়ে যান। পাশাপাশি প্রযুক্তির প্রতি টানও বাড়তে থাকে।
প্রযুক্তি ছেলেদের বিষয়, এমন মন্তব্য অনেকবার শুনেছেন মুমতাহিনা। “মেয়ে হয়ে এত বড় স্বপ্ন দেখা যায় না”—এমন কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। তবু দমে যাননি। পরিবার, বিশেষ করে মায়ের সহযোগিতা তাকে সাহস জুগিয়েছে।
মুমতাহিনা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে দেশের জন্য কাজ করতে চান। তার বিশ্বাস, বাংলাদেশে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের বড় সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
মায়ের কথা দিয়ে শেষ করা যায়, “মুমতাহিনার আগ্রহের জায়গায় আমরা সব সময় তাকে সমর্থন দিয়েছি। সবাই তার সাফল্যের জন্য দোয়া করবেন।”