ঢাবি-রাবি কখনই ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ‘প্রাচ্যের কেমব্রিজ’ ছিল না
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২২, ১০:০৯ AM , আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২২, ১০:৩৮ AM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের কেমব্রিজ’ আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেকেই। দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠ দুটি অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে কিছু অবকাঠামো ও শিক্ষার কারিকুলাম মিলে যাওয়ায় অনেকে বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় দুটির সাথে এদের তুলনা করে থাকেন। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, ঢাবি-রাবির এই উপাধির কোন ভিত্তি নেই। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দুটি নিজেই।
সময়ের ব্যবধানে ঢাবি-রাবির অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহও দিগুণ থেকে বহুগুণ বেড়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে শিক্ষার মান, গবেষণা সুনাম, অভিনবত্ব ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কতটা এগিয়ে দেশের প্রাচীনতম এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত? সেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে শতবর্ষে পা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতবর্শী বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে কীভাবে পরিচিতি পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লেখা একাধিক গবেষণাগ্রন্থ তথা সরদার ফজলুল করিমের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’ এবং সৈয়দ আবুল মকসুদের লিখিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’— বই দুটিতেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বাংলাপিডিয়াতে উল্লেখ আছে, ‘১৯২১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণে এটি স্থাপিত হয়। সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হবার প্রেক্ষাপটে এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে স্বীকৃতি পায়।’
তবে এমন তথ্য উড়ে যায় যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামের বক্তব্যে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো এ অঞ্চলের পুরনো ও প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এই অঞ্চলে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে কোন আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাও পরিপূর্ণ আবাসিক ছিল না।
তিনি বলেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থার জন্য কলেজ রয়েছে; তেমনি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল রয়েছে। এ ছাড়া আর কোন মিল নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ে বলা হয়েছিল—এই প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীই হলে থাকবে। উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়। আসলে এর কোন দালিলিক প্রমাণ বা ভিত্তি নাই।
তিনি আরো বলেন, আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন শুনতাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হলো এশিয়ার বৃহত্তম হল; আর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হলো এশিয়ার বৃহত্তম রেলওয়ে স্টেশন। এই কথাগুলো যেমন ভিত্তিহীন, তেমনি ঢাবিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলাটাও ভিত্তিহীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কিনা—তা নিয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রশ্নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশ্বের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের বক্তব্য হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। তার ভাষ্য, যেখানে দেশের সরকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে থাকে; সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে অবদান রেখেছে। এমনটা সাধারণত হয় না।
আরো পড়ুন: ভাস্কর্যে ভাস্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অন্যদিকে, দেশের বৃহত্তর ও পুরনো ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। ইতিহাস ঐতিহ্যের দৌঁড়েও অনেকটা এগিয়ে মতিহারের লীলাভূমিতে গড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়। জন্মলগ্ন থেকেই অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে দেশের অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ, গবেষণার সুনাম, প্রভাব, অভিনবত্ব ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট এগিয়ে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে একটি গৌরব ও ঐতিহ্যময় অতীত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাঙ্গালি ইতিহাসের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। ১৯৬২ সালের বিতর্কিত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলনে, ৬৬ এর ছয়-দফা, ‘৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। এমনকি অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবরও দিয়েছেন অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। ফলে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের একটি পতাকা। যেটা বিশ্বে অন্যদের তুলনায় বিরল।
দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এখানে তুলনামূলক ভালো গবেষণা হয়। এখানে রয়েছেন অরুণ কুমার বসাকসহ অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক। যাদের গবেষণা দেশবিদেশে অনেক সমাদৃত। সম্প্রতি স্কোপাস’র প্রকাশিত জরিপে গবেষণাকর্মসমূহ এবং গবেষণা সংশ্লিষ্ট পরিমিতির নিরিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষস্থান অর্জন করেছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গবেষণা কার্যে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ ও মান সম্মত গবেষণার পরিমাণ খুবই কম। যেটা দিয়ে বিশ্ব র্যাংকিং-এ টিকে থাকা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিখ্যাত কেমব্রিজের সাথে তুলনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ও ডিরেক্টর ড. গোলাম কবির বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কখন প্রাচ্যের কেমব্রিজ বলা হয়েছে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন নথিপত্রে উল্লেখ আছে বলে আমার জানা নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ৪৫ বছরের শিক্ষা ও চাকরিজীবনে আমি কখনও প্রশাসনের কাউকে একথা বলতেও শুনিনি।
তিনি বলেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশ্বের প্রচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম। যেখানে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যার সুনাম ও সুখ্যাতি বিশ্বের বুকে সমাদৃত। যেখানে নিউটন, ডারউইন, ফ্রান্সিস বেকনসহ বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে। এখন সেখানে বিশ্বের বিখ্যাত গবেষক ও বিজ্ঞানীদের পদচারণায় সবস্থান ধরে রেখেছে বিশ্ববিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
আরো পড়ুন: শিক্ষা-গবেষণার মান বাড়াতে রাবিতে কমছে আসন
তিনি আরও জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের কেমব্রিজ ছিল/আছে কিনা? এ নিয়ে বিতর্ক করার চেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে আন্তরিক হওয়া বেশি জরুরি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের কেমব্রিজ কিনা তা জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডসহ বিশ্বের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও একধাপ এগিয়ে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. সুলতান-উল ইসলাম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেমব্রিজের সাথে তুলনা করা যায় কিনা সেটা বড় বিষয় নয়। আমরা একটা বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর তুলনা তখনই করি, যখন তাদের মধ্যে যথার্থ মিল খুঁজে পাই। আমরা প্রাচ্যের শেক্সপিয়ার বলি চীনের বিখ্যাত নাট্যকার ‘কুয়ান হান ছিংকে’-কে। তেমনি প্রাচ্যের হোমার বলা হয় কবি ফেরদৌসীকে। আবার প্রাচ্যের গ্রেট ব্রিটেন বলা হয় জাপান-কে। এগুলো উপমা হিসেবে বলা হয়ে থাকে।
তেমনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো কিংবা শিক্ষা পদ্ধতি ও সিলেবাসের মিলের কারণে হয়তো অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের কেমব্রিজ আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিখ্যাত কেমব্রিজের মত এতো বিশ্বসেরা মহামানবের দেখা না পেলেও পেয়েছে অনেক পণ্ডিত, গবেষক, জ্ঞানতাপস ও ত্যাগী মনীষীর। যাদের শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় অর্জন করেছে সুনাম ও খ্যাতি।
তিনি জানান, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ, গুনগত মান, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে যথাযথ বরাদ্দ এবং স্বজনপ্রীতি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে এসে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যম ও সবার যৌথ প্রচেষ্টায় হয়তো একদিন আমরাও বিশ্বের নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে নিজেদের পৌঁছাতে সক্ষম হব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এর সঙ্গে কেমব্রিজের তুলনা করে খুব একটা ফয়দা হাসিল হবে না।
‘বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলেই পরিচয়’ জনৈক মনীষীর মতে, ‘অনুকরণ করার মধ্যে সৃষ্টি করার আনন্দ নেই। কিছু করে যদি আনন্দ পেতে চান। সুনাম অর্জন করতে চান। তবে নিজের মতো হোন।’ তাই নিজ যোগ্যতা ও কর্মপ্রচেষ্টায় বিশ্বের বুকে স্থান করে নিতে হবে। তার জন্য চাই সৎ যোগ্য নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। ঢাবি-রাবি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ এটা কোনও সার্টিফিকেট প্রাপ্ত অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ নয়। এটা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছে ঢাবি ও রাবি প্রতিনিধি