রাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির নেতৃত্বে ছাত্রলীগ!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির নেতৃত্বে রয়েছেন ছাত্রলীগের দুই নেতা। মঙ্গলবার ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার বিভিন্ন শিফটে প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হন পাঁচজন। তাদের মধ্যে রাবির ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বায়েজিদ খান স্বীকার করেন, রাবি শাখা ছাত্রলীগের সংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের নির্দেশে তিনি ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়েছেন। অপরদিকে আটক হওয়া আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এখলাছুর রহমান। তিনি ঢাবির মুহসিন হল শাখা ছাত্রলীগের পূর্বের কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
মঙ্গলবার বিকেলে আটক হওয়ার পর কয়েক ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বায়েজিদ খান ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়ের নির্দেশেই ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। এদিন প্রক্সিদাতা চারজন এবং একজন ক্যান্ডিডেটসহ মোট পাঁচজনকে দণ্ডিত করে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বায়েজিদ খান। সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবনে ‘এ’ ইউনিটের গ্রুপ-২ এর ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে এসে ধরা পড়েন তিনি। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দফতরে নিয়ে আসেন। সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বায়েজিদ খান বলেন, ছাত্রলীগ নেতা তন্ময় তাকে পরীক্ষায় বসিয়েছেন। পরে জিজ্ঞাসাবাদের একটি ভিডিও গণমাধ্যমের হাতে আসে।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে এই কাজ কে দিয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে বায়জিদ জানান, তারই বিভাগের বন্ধু ও রাবির ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময় তাকে প্রক্সির কাজ দিয়েছেন। তিনি প্রক্সি দিতে সকালে ক্যাম্পাসে এসেছেন। প্রক্সি দেওয়ার পূর্বে তিনি তার ব্যক্তিগত ফোন তন্ময়ের কাছে জমা রেখেছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুশফিক তাহমিদ তন্ময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্ মখদুম হলে থাকেন। এর আগেও তন্ময়ের বিরুদ্ধে ভর্তি জালিয়াতি, সিট বাণিজ্যসহ রাবি ও রুয়েট ক্যাম্পাসে ইয়াবা ও মাদক পাচারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ সংক্রান্ত সংবাদও প্রচারিত হয়েছিলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
আরও পড়ুন: জাবির ভিসি প্যানেল নির্বাচন ১২ আগস্ট
এবিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের সঙ্গে যেগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনটি বন্ধ রয়েছে। শাহ্ মখদুম হলে গিয়ে জানা গেছে ওই ঘটনার পর থেকে তিনি আর হলে আসেননি।
এদিকে তন্ময়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা। তারা অভিযুক্তের শাস্তির দাবি জানান। শাখা ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল গালিব বলেন, ‘ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের দূর্নীতির মাধ্যমে তন্ময় কোটিপতি বনে গেছে। বিলাসবহুল জীবন যাপন করে সে। প্রকৃতপক্ষে এরা ছাত্রলীগের কলঙ্ক।’ তন্ময়কে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারের দাবিও তুলেছেন শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা।
ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সির সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা’ থাকায় মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, এ বিষয়টি আমরা শুনেছি। আমরা খুব দ্রুতই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে এ ঘটনায় প্রমাণসাপেক্ষ তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মেহেদী হাসান তাপস বলেন, এই বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। তবে সে যদি সত্যিকার অর্থে এমনটা করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্তদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের একজন স্বীকার করেছেন যে, তন্ময় জড়িত রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা প্রশাসনকে তদন্ত করতে অনুরোধ জানিয়েছি।
আরও পড়ুন: আপাতত সন্দেহমুক্ত বুলবুলের ‘প্রেমিকা’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, আইন সব সময় আইনের গতিতেই চলবে। ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি চক্রের সাথে যে বা যারা জড়িত, তাদের পরিচয় যতই শক্ত হোক না কেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। বিশ্ববিদ্যালেয় প্রশাসন এবং গোয়ান্দা সংস্থা সর্বদা তৎপর রয়েছেন। আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত প্রমাণসাপেক্ষ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারবো।
উল্লেখ্য, রাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এখলাছুর রহমান, লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মেহজাবিন, রাবির ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী বায়জিদ খান, খুলনার গাজী মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের প্রভাষক ডা. সমীর রায় ও মোহাম্মদ রাহাত আমীন রিয়াদ নামের এক ভর্তিচ্ছু। মঙ্গলবার ‘এ’ ইউনিটের পরীক্ষা চলাকালীন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে জান্নাতুল মেহজাবিনকে দুই বছর ও এখলাছুর রহমান, বায়েজিদ খান ও সমীর রায়কে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমান আদালতের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কৌশিক আহমেদ। এছাড়াও পরীক্ষার্থী রাহাত আমীন রিয়াদকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওযা হয়।