ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৮ মাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার ২৬ শিক্ষার্থী

৮ মাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার ২৬ শিক্ষার্থী
৮ মাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার ২৬ শিক্ষার্থী  © ফাইল ছবি

করোনা মহামারী স্বাভাবিক হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খোলার পর থেকে এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ২৬ জন শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না যাওয়া, ছাত্রলীগের সিনিয়রদের সালাম না দেয়া, সালাম দিতে দেরি করা, বড় ভাইদের নির্দেশের বাইরে কিছু করা, গেস্ট রুমে আসতে দেরি করাসহ উদ্ভট সব নিয়মের কারণে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।

কেউ তাদের তৈরি এই নিয়ম-কানুনের অবাধ্য হলে বা কর্মসূচিতে অংশ না নিলে রাতে গেস্ট রুমে তাঁর ‘বিচার’ করে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মীরা। অনেক সময় ‘শিবির কর্মী’, ‘ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মী’ আখ্যা দিয়েও গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয়। এমনকি এসব ট্যাগ দিয়ে পুলিশে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ১০ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে নভেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের খেলা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করা এবং বন্ধুর সেই ফেসবুক পোস্টে লাইক করায় দুই শিক্ষার্থীকে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে।

এছাড়া গত ২৬ জানুয়ারি (বুধবার) রাতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আকতারুল ইসলামকে গেস্টরুমে নির্যাতন করার ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে ৬ মাসের জন্য হল থেকে বহিষ্কার করে বিজয় একাত্তর হল প্রশাসন।

এরপর মার্চের ২৬ তারিখে রুমে ঢুকে ওই হলেরই আবাসিক ও স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত দুই শিক্ষার্থীর ওপর অতর্কিত হামলা করে হল ছাত্রলীগের সাত থেকে আটজনের একটি দল। এ ঘটনায় হল প্রশাসন ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে ছয়জনকে আজীবনের জন্য হল থেকে বহিষ্কার করে। যদিও এদের সবাই এখনো হলে অবস্থান করছে বলে হল ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া চলতি মাসের ১৫ তারিখ গেস্ট রুমে যেতে দেরি করায় প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে ওই হলের এক ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে।

করোনার মহামারীর কারণে একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো বন্ধ ছিল। পরে ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খুলে দেয়া হয়। করোনা প্রতিষেধক এক ডোজ টিকা নিয়েছেন এবং হলের বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারবেন- এসব শিক্ষার্থীদের হলে উঠতে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে, গত ৬ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে বিভিন্ন আজেবাজে কাজ করতে বলা হয়। এসময় সে পারবে না বলে জানালে তার ওপর চড়াও হয় পরাগ নামে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগের এক কর্মী। এসময় পরাগ তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে এবং তার গায়ে হাত তুলতে যায়। পরে ওই রাতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে গেস্টরুম থেকে বের করে দেয়‌ পরাগ।

মাস্টারদা সূর্য সেন হলে চলতি মাসের ২৪ তারিখে সালাম দিতে দেরি করায় এক শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর করেন ওই হলের এক ছাত্রলীগ কর্মী। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

এছাড়া, গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করায় এক শিক্ষার্থীকে ডেকে মারধর করেন স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রলীগ সভাপতি তানভীর শিকদার। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করলে তাকে পরেরদিন রাতে হল থেকে বের করে দেয় তানভীর।

মার্চের ১০ তারিখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আবু তালিব নামে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন করে ওই হলের ছাত্রলীগের চার কর্মী। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো তার কোন বিচার হয়নি।

আরও পড়ুন: ঢাবির হলে সাত বছরে নির্যাতনের শিকার ২৮২ শিক্ষার্থী

এছাড়া চলতি মাসের ১৮ তারিখে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় তৃতীয় বর্ষের ১৫ শিক্ষার্থীকে গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেয় ওই হলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রলীগের কর্মীরা। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে পরেরদিন আবার তাদের হলে ওঠানো হয়।

অন্যদিকে গত বছরের ১৮ নভেম্বর স্যার এ এফ রহমান হলে ‘গেস্ট রুমে হাজিরা’ বন্ধের সিদ্ধান্তের খুশিতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় ৩ ছাত্রকে বেধড়ক পেটানো হয়। এটি ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের অনুসারীর গ্রুপ ছিল।

এরপর ২৫ জানুয়ারি সিনিয়রদের কথা না মানায় ওই হলের দুই শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে ডেকে এনে চড়-থাপ্পড় মারা হয়। এছাড়া গত মাসে ছাত্রলীগ নেতার নামে নিউজ না করার অভিযোগে এক সাংবাদিককে মারধর করে ওই হলের এক ছাত্রলীগকর্মী।

গত বছরের অক্টোবরে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ওই হলের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে সালাম না দেয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না যাওয়ায় মারধর করা হয়। এছাড়া গত বছরের ২১ নভেম্বর ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে গিয়ে তাদের বের করে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস গ্রুপের ওই হলের পদপ্রত্যাশী মো. সারোয়ার হোসেন ও সানোয়ার হোসেন নাঈমের বিরুদ্ধে।

এছাড়াও ৭ নভেম্বর রাতে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করার অভিযোগে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের তরিকুল ইসলাম এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের মো. আরিফুল ইসলাম নামের দুই শিক্ষার্থীকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে মারধর করেন ছাত্রলীগ কর্মী সিফাত উল্লাহ ও তার এক বন্ধু।

এ ঘটনার পর তার কাছ থেকে মুচলেকা নেয় হল প্রশাসন। কিন্তু এই ঘটনার এক মাসের মাথায় ১৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে না যাওয়ায় ফারসি ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী পরশ মিয়াকে হলের ৩৫১ নম্বর কক্ষে মিনি গেস্টরুমের জন্য ডেকে মারধর করেন সিফাত। যদিও পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবাসিক হল থেকে তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়।

এদিকে মেয়েদের হলেও গেস্টরুমের নামে শিক্ষার্থীদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ নভেম্বর রোকেয়া হলের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রথম বর্ষের দুই শিক্ষার্থীকে রাতভর র‍্যাগিংয়ের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে হলের তৃতীয় বর্ষের পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এক ছাত্রীকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে নাচতে বাধ্য করা হয় সে রাতে।

তবে ছাত্রলীগ এসব নির্যাতনের অভিযোগ বরাবরের মতোই অস্বীকার করে আসছে। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দপ্তর সম্পাদক মেফতাহুল আলম পান্থ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গেস্ট রুমের যে কালচার এটা ছাত্রলীগের মধ্যে নেই। আগে ছাত্রদলের সময় গেস্ট রুমে র‌্যাংগিং হতো। এখন আমরা সেটা বন্ধ করেছি। তবে এরকম কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলে সেটার বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এগুলোকে আগে থেকেই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ও ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে আসছে। প্রশাসন বলছে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এগুলো অহরহ কোন ঘটনা নয়। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এগুলো হল প্রশাসনের নজরে আসলে তারা ব্যবস্থা নেয়। কখনো এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট দুষ্টু চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গেস্ট রুমের নামে নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন করার দাবি জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি উপাচার্য বলেন, আইন আছে। যেকোন ধরনের অপরাধের জন্য আইন আছে। অপরাধ হলে ঘটনা তদন্ত করে তার প্রয়োগ করতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ