অতিমারীতেও অর্জনে অনন্য জাহাঙ্গীরনগর
সংস্কৃতির রাজধানী অভিধাটি শুনলে মনে পড়ে যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা। যেখানে, বছরের প্রায় সময়ই হত কোন কোন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু অন্য সব কিছুর মত করোনা অতিমারী থমকে দিয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। এর ফলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গত বছরের মার্চ থেকে শারিরীকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম করছে না। তাই বলে পিছিয়ে নেই বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রা। থমকে যাওয়া এই সময়ে দারুণ কিছু অর্জনের মাধ্যমে চমকে দিয়েছে দেশবাসীকে।
আন্তর্জাতিক ডিবেট টুর্নামেন্ট ও জেইউডিও’র সীমানা পেরোবার গল্প
চারিদিকে তখন ভয়ের ছড়াছড়ি। কঠিন সময়ের মুখোমুখি পৃথিবী। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র,ভেন্টিলেশন আর উচ্চ প্রবাহমাত্রার অক্সিজেন এর জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছে স্বজন-পরিজনের প্রাণ বাঁচাতে। দুঃখজনক হলেও সত্য তখনও কিছু মানুষ দুর্নীতির মহোৎসবে মেতে ছিলেন। যা আহত করেছে অনেককেই -আহত করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট অর্গানাইজেশন(জেইউডিও) কেও। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমস্ত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। এবার করোনাকালে তার প্রমাণ রাখলেন অন্যরকম বাস্তবতায়। অনন্য মাত্রা সংযোজনের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: আদিবাসী কোটা পুনর্বহাল না হলে ২৮ এপ্রিল থেকে অবরোধের হুঁশিয়ারি
এটি একই সাথে চলমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে,আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালন এবং ইউনাইটেড এশিয়ান ডিবেট কম্পিটিশন(ইউএডিসি-২০২০) প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আয়োজিত হয়েছে। ইউএডিসি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বিতর্ক প্রতিযোগিতা। যা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেইউডিও’র ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক ডিবেট টুর্নামেন্ট। যা নির্মাণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি বিতর্ক সংগঠনের সীমানা পেরোবার গল্প। শুরুটা ‘কোভিড মোকাবিলায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুন্য সহনশীলতা: দুর্নীতি বন্ধ করো, জীবন বাঁচাও’ বিষয় নিয়ে। নিবন্ধন ফি বিহীন এই প্রতিযোগিতায় দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ টি বিতর্ক দল এবং অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বিচারকবৃন্দসহ প্রায় দেড় শতাধিক তরুণ অংশগ্রহণ দর্শকদের উদ্দীপ্ত করেছিল। ২৭-২৮ নভেম্বর প্রতিযোগিতার বিভিন্ন পর্বের পঞ্চাশোর্ধ অধিবেশন শেষে ২৯ নভেম্বর ফাইনাল বিতর্ক, বিতর্ক শেষে অনলাইনে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অংশগ্রহণে মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এই ইতিহাস বিনির্মাণে সঙ্গী হয়েছে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টার। দেশের মূলধারার মিডিয়া গুলোর মিডিয়া পার্টনার হিসেবে থাকা অনুষ্ঠানটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব: ত্রিমাত্রিক বাস্তবতায়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের জন্য এই বছর বাহ্যত বহুমাত্রিক বাস্তবতার, বিশেষত কালিক প্রেক্ষাপটে। অর্ধশতাব্দী কাল পরে ছাড়া এরকম মুহূর্ত পাওয়াটা অনেকটা অসম্ভব হবে হয়তো। এবছর বাংলাদেশ যেমন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে, তেমনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। আর এ উদযাপনকে স্মরণীয় করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ আয়োজন করেছে দেশের প্রথম অনলাইন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব।
এ বিষয়ে সুবর্ণজয়ন্তী সাহিত্য উৎসব-২০২১ এর আহ্বায়ক মাশরুর শাহিদ হোসেন বলেন, ‘করোনাকালীন ধকল, অসহায়ত্ব ও মনোবৈকল্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনলাইন সংযোগের সুবাদে জ্ঞান, ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতার বিনিময়মূলক আলাপচারিতা উস্কে দিতে এবং তার মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান, সময় ও অবস্থার মানুষদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সহমর্মিতার উৎসারণের মানসে করোনাকালে ইংরেজি বিভাগের এই আয়োজন। কেবল মাতমে বা দোষারোপে নয়, বরং স্মরণে, সম্পর্কে, নবায়নে (reflect, rejoice, renew) আমরা অতিক্রম করতে চাই এই ট্রমাক্রান্তকাল’।
সবার জন্য উন্মুক্ত এই লিট ফেস্ট-এ ছিল বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ১৮টি সেশন: এর মধ্যে ১৩টি সাক্ষাৎকারমূলক বৈঠক জুড়ে সাম্প্রতিক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক আলাপনে জমে উঠেছিল। এখানে যেমন ছিল বিদেশী সাহিত্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন তেমনি ছিল বাংলাদেশ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখকগণের কথা, ছিল কানাডীয় কবিতার স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টাও। উঠে এসেছে আফ্রিকী দর্শনের না-জানা বয়ান, চীনা, কোরীয় ও ইরানীয় চলচ্চিত্রের শিল্পতত্ত্বের নানাবিধ প্রসঙ্গ। প্রান্তিক মানুষজনের সাহিত্য নিয়ে আলাপ ইন্ডেজেনাস স্ট্যাডিজের মতো তত্বীয় আলাপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি উৎসবটি বরং আমেজ ছড়িয়ে দিতে ছিল অনলাইন নাটক ,কবিতা-আবৃত্তির আসর, রিকশা চিত্রশিল্প নিয়ে উপস্থাপনা। সবশেষে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এবারের মতো পর্দা উঠে পুরো ব্যতিক্রমধর্মী এই অনুষ্ঠানের। শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য অভিনব ও দারুণ এ উৎসব দেশকে চমকে দিয়েছিল।
চ্যাম্পিয়নশীপের মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু সাঁতার দলের
‘আমাদের পুরাতন সুইমিং পুল পরিত্যক্ত। নুতন সুইমিং পুল তৈরি হতে আরো হয়তো বছর ৩ লেগে যাবে। নেই কোন প্রফেশনাল সাঁতারু। গতবারের চ্যাম্পিয়ন সাগর নৌবাহিনীতে অনুশীলন করে। কিন্তু কয়েকদিন আগে ওর মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়ে যাওয়ায়, ও খেলতে পারিনি। কিন্তু আমরা থেমে নেই। যা আছে তাই নিয়েই শুরু করেছি’।কথাগুলো জাবির শারীরিক শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক সাদাত হোসেন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও হলেও ছিল বাস্তবতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের পুকুরেই সাঁতার অনুশীলন করে প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই ৪*১০০ মিটার রিলেতে ব্রোঞ্জ পদক জয় করে। সুইমিং কস্টিউম না থেকেও অদম্য ইচ্ছে শক্তি আর গভীর অনুশীলন তাদের যাত্রাকে করেছে স্মরণীয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সায়েন্স ক্লাবের গোল্ডেন এ্যাওয়ার্ড
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি সায়েন্স ক্লাব (জেইউএসসি) পরিণত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান ক্লাব হিসেবে। বহু অর্জনে সমৃদ্ধ এই সংগঠনটি মহামারীকালে এবারের অর্জন ও বিরাট। ইউনিভ আয়োজিত আন্তর্জাতিক পোস্টার প্রতিযোগিতায় জাবি সায়েন্স ক্লাবের দুটি দল গোল্ডেন এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। এখানে ভারত,পাকিস্তান, চীন, আমেরিকা, ডেনমার্ক, ইতালি, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার মত দেশগুলোর ৮৬ টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দু’শ উনিশ টি পোস্টার জমা পড়েছে। এমনকি বাংলাদেশের ২১টি বিশ্ববিদ্যালয় এখানে নিজেদের সেরাটুকু দেয়ার চেষ্টা করেছে। সবকিছু ছাড়িয়ে ইতিহাস হলো প্রথমবারের মত অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিযোগিতায় একই সংগঠনে একই সাথে দুটি দলের গোল্ডেন এ্যাওয়ার্ড অর্জন। আরিফুল ইসলাম ও রুফাইয়াত হোসাইনের নেতৃত্বে জাবি সায়েন্স ক্লাবের দুটি দলের এই অর্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বড় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।