করোনায় অনিশ্চয়তায় শিক্ষাজীবন, হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
- বেলাল হোসেন, জাবি
- প্রকাশ: ১১ জুন ২০২১, ০৭:৩৬ PM , আপডেট: ১২ জুন ২০২১, ০৯:৪৭ AM
মশিউর রহমান, বয়স ২৫। পড়েন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী এখনো উত্তীর্ণ হয়নি তৃতীয় বর্ষে। করোনার ১৫ মাস গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে অবস্থান করছেন মশিউর। হতাশা ও বিষন্নতায় নিমজ্জিত তার ব্যক্তি জীবন। সেই সাথে তার উপরে রয়েছে পরিবার থেকে উপর্জন যোগানোর চাপ।
তিনি বলেন, আমার স্নাতকের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা এখনো হলো না। এতোদিনে স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার কথা। অথচ বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু চাকরি পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জন হচ্ছে না। যতই চেষ্টা করি মনের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনের মধ্যে দিনকে দিন অসংলগ্ন চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক করছে।
মশিউরের মতো অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর। সম্প্রতি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ ধরণের একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। নিবন্ধটি গত এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘‘জার্নাল অব পাবলিক হেলথ, নেচার অব স্প্রিঞ্জার’-এ প্রকাশিত হয়।
Assessing the mental health condition of home-confined university level students of Bangladesh due to the COVID-19 Pandemic শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ৪.৩২ শতাংশ হালকা; ৭২.৭ শতাংশ মধ্যম; ১২.৫৭ শতাংশ মাঝারিভাবে মারাত্মক এবং ১০.৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে।
গবেষণাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তিনজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী করেন। তারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক নাহিদ সালমা, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম ও ফেরদৌস বিন আলী।
সহকারী অধ্যাপক নাহিদ সালমা বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। গবেষণাটি লকডাউন পিরিয়ডের সময় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে করা হয়েছে। একটি অনলাইন-ভিত্তিক প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে ও সুবিধাজনক স্যাম্পলিং ব্যবহার করে ৫০৯ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিলো। গবেষণায় শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের স্কোরের উপর ভিত্তি করে তাদের চারটি বিভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিলো।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একটি বৃহত অংশ লকডাউন চলাকালে মানসিকভাবে অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। চাকরির সুরক্ষা প্রদান, পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগের দৃষ্টিভঙ্গি, মিথ্যে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচাররোধ করা এবং ঘরোয়া ক্রিয়াকলাপে ব্যস্ততা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নতি জন্য সহায়তা করতে পারে।
খাইরুল ইসলাম বলেন, জরিপে ৫০৯ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন। যেখানে ৩৫৮ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৫১ জন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর মধ্যে ২৯৮ জন ছাত্র ও ২১১ জন ছাত্রী। এদের মধ্যে ৯৭.৭ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছর এবং ৮৮.৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পরিবারের সাথে বসবাস করছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা মানসিকভাবে অস্থির সময় অতিবাহিত করছি। জানিনা এর শেষ কোথায়। ইতোমধ্যে আমাদের শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত। বিপরীতে পরিবারের প্রত্যাশা বাড়ছে বয়সের সাথে। এমন অবস্থাতে মানসিক যন্ত্রণা দূরীকরণে নেই পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক তাজউদ্দীন শিকদার বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যখন বাহ্যিক করোনা লড়াইয়ে ব্যস্ত তখন শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা বিষন্নতায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলো নিরুদ্বিগ্ন। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে তাই সর্বপ্রথম শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গত ১৫ মাসে মাত্র দুটি কাউন্সেলিংয়ের আয়োজন করতে সক্ষম হয়। সেটাও আবার গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে। গত ছয় মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শ কেন্দ্র কোন ধরণের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও গত ফেব্রুয়ারী মাসের ২২ তারিখে একটি কাউন্সেলিং প্রোগ্রামের বিজ্ঞপ্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। কিন্তু পরদিনই সেটির স্থগিতাদেশ ওয়েবে ঝোলানো হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যান ও পরামর্শ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, গত প্রোগ্রামটি উপাচার্যের সময় শিডিউল ম্যাচিং না করায় স্থগিত হয়। আমরা আবারো এ ধরণের আয়োজন করবো। তবে উপযুক্ত সময়ের প্রয়োজন আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক (মনোবিজ্ঞান) ইফরাত জাহান বলেন, মহামারির ১৫ মাসের মধ্যে প্রথম সাত মাসে মাত্র ২০ জন শিক্ষার্থী আমাদের কাছে কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তী সাত মাসে এ সংখ্যাটি প্রায় ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তাই শিক্ষার্থীদের বিষন্নতার মূল কারণ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।