ইটভাটায় কাজ করে স্কুলজীবন পার, ঢাবিতে এসে আর চলছে না বাচ্চুর

  © টিডিসি ফটো

ইচ্ছে ছিল অন্য আট-দশজনের মতোই পড়াশোনা করে বড় হওয়ার। কিন্তু সাধ এবং সাধ্যে কুলাচ্ছিল না তার। আর্থিকভাবে ভঙুর পরিবার থেকে বেড়ে উঠে লেখাপড়ার ইচ্ছেটা ছিল অনেকটাই দুঃস্বপ্নের মতো। তবুও সাহস হারায়নি। সব প্রতিকূলতা জয় করে হাসতে চেয়েছেন সুখের হাসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই হাসি ধরে রাখার ধৈর্য্যে পেরে উঠতে পারছেন না। ইটভাটায় কাজ করে, অন্যের ফসল কেটে দিয়ে পার করেছেন স্কুল-কলেজ; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এখন যেন আর চলছে না তার।

গল্পটা শত প্রতিকূলতা জয় করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম বাচ্চুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী তিনি। করোনার কারণে বর্তমানে ঝিনাইদহের কয়ারগাছী আবাসন প্রকল্পে (সরকারি বস্তি) পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন।

মো. আবু তাহের এবং জবেদা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে বাচ্চুর অবস্থান তৃতীয়। বড় ভাই আদম আলী (বিবাহিত) পেশায় ভ্যানচালক। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে টানাটানির সংসার তার। বড় বোন ইয়াছমিন খাতুন বিবাহিত। ছোটবোন জেসমিন খাতুন ১০ম শ্রেণির ছাত্রী।

এর আগে বাচ্চুর পরিবার কেশবপুরে থাকতেন। দাদার সামান্য একটু জমি থাকলেও সেটা ছোট চাচার নামে লেখে দেন তিনি (বাচ্চুর দাদা)। কেশবপুরে কাজের সুবিধা না থাকা এবং নিজের পরিবারের কোনো স্থায়ী জমিজমা না থাকায় চলে ঝিনাইদহে চলে আস তার পরিবার। ২০০৪ সাল থেকে কয়ারগাছী বস্তিতে বাস করছেন তারা।

ঝিনাইদহের বিষয়খালী এস এম স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। তবে তার স্কুল-কলেজের জীবনও ছিলো বেশ সংগ্রামের। প্রতিকূলতা জয় করতে করতে নিজেকে দেশসেরা বিদ্যাপীঠে ভর্তি করাতে সক্ষম হন তিনি।

স্কুল-কলেজের পড়ালেখা এবং এর খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে বাচ্চু বলেন, অনেক  সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। এমন কোনো কাজ বাদ নেই যেটা করিনি; আর যেটা পারি না। ইটভাটায় ইট উল্টানোর কাজ করেছি, কয়লা কুড়িয়ে নিজের ব্যাগ কিনেছি; গাড়ির লেবারও ছিলাম। ধানকাটা, মাছধরা এসব কাজ করে নিজের পরিবারের জীবিকার যোগান এবং নিজের পড়ালেখা করেছি।

বাচ্চু বলেন, বই কেনার টাকা ছিলো না। কারণ, যে টাকা দিয়ে বই-গাইড কিনবো সে টাকা দিয়ে আমার পরিবারের খাবার যোগান হবে। পরে বন্ধুদের বই থেকে পড়া লিখে নিয়ে আসতাম। হাটতে হাটতে পড়তাম। ছাগল চড়াতে গিয়ে বই পড়তাম। এভাবে আমার পড়া হয়ে যেত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথমেই খাওয়ার কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে চলতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নয়ন হওলাদার ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথম বর্ষে আমার বিনা পয়সায় হলের ক্যান্টিনে খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।

এর আগে হলের প্রোগামে না যাওয়ায় হলের মাঠের মধ্যে তাকে মারধর করা হয়েছিল। খাবার খেতে গেলে এক ছাত্রনেতা মারধরও করেন। এ কথা বলতেই কান্না ভেঙে পড়েন বাচ্চু। তবে হল সাধারণ সম্পাদক তার অবস্থা জানার পরে তার জন্য বিনা পয়সায় খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়াও সাংগঠনিক কর্মসূচিতে না যাওয়ার অনুমতি দেন। যদিও, বাইক এক্সিডেন্টের কারণে বর্তমানে মারত্মক অসুস্থ থাকায় বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নয়ন হাওলাদারের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

জানা যায়, সম্প্রতি করোনার পরিস্থিতির কারণে নিজেদের অসহায়ত্বের বর্ণনা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এক স্ট্যাটাস দেন বাচ্চু। সেই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে তার সম্পর্কে জানতে গিয়ে এক অসহায় পরিবারের চিত্র উঠে আসে। দিনমজুর বাবার ঘাড়ে থাকা পরিবারের সাথে বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে যাচ্ছে বাচ্চুর দিনরাত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের অসহায়ত্বে ফিরিস্তি তুলে ধরে বাচ্চু বলেন, আমার বাবা দিনমজুর। আমার বাবা ও মা দুজনই অসুস্থ। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমার মা অসুস্থ অবস্থায় আছে এজমা রোগী (বাস এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে)। আমার বাবাও বর্তমানে মিনি স্ট্রোক এ ভুগছেন। সবাই ওষুধ এর উপরেই আছন। আমার বাবা অসুস্থাবস্তায় এখন নারিকেল গাছ সাফ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আমি ভার্সিটিতে থাকা অবস্তায় নিজের খরচ নিজে চালিয়েছি। পাশাপাশি আমার শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, ক্যাম্পাস এবং হলের বড় ভাইয়েরা সহযোগিতা করছেন। কিন্তু আমি বাড়ি থাকা অবস্থায় আমার ভরণপোষণও আমার বাবার উপর বর্তায়। এখন বাবা কাজ করলে খাই। না করলে খাই না।

এদিকে, কয়ারগাছী বস্তিতে প্রায় আরো ২০০ পরিবার থাকেন। সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। বস্তিবাসীর জন্য রয়েছে একটি মাত্র পুকুর। ১০টি পরিবারের জন্য রয়েছে এক থেকে দুইটা টয়লেটের ব্যবস্থা। আগে ধর্মে-কর্মে মনোযোগ না থাকলেও করোনাকালীন সময়ে ধর্মীয় তাহজিব তামাদ্দুন মেনে চলার চেষ্টা করছেন তিনি। আগে সাদামাটা ক্লিন সেভ করলেও বর্তমানে দাড়িতে মুখ ঢাকা বাচ্চুর। বর্তমানে নিজের পরিবারের পর্দার বিষয়টি উপলব্ধি করে তাদের জন্য আলাদা গোসলখানা-টয়লেট স্থাপনের কথা ভাবছেন। তবে তার পক্ষে এর খরচ বহন করা সম্ভব না হওয়ায় সহযোগিতা চাইছেন।

এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, আমি করোনাভাইরাসের পর দ্বীনের পথে ফিরে এসেছি। তাই আমি চাচ্ছিলাম আমার পরিবারও পর্দায় থাকুক। তারা থাকতে চায় কিন্তু পারে না। কারণ, আমার বাসা থেকে পুকুর অনেক দূরে (সরকারি পুকুর)। আবার দশটি পরিবারের একটি/দুইটি টয়লেট। তাই আমি চাচ্ছিলাম আমার বাসায় একটি টয়লেট ও গোসলখানা নির্মাণ করতে। যাতে আমার পরিবার পর্দায় থাকতে পারে। এমতা অবস্তায় আমার পরিবারে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আমার উপরেই বর্তায়। তাই কেউ আমাকে সাহায্য করলে আমি আমার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারতাম।

স্ট্যাটাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এখন বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আরবি পড়াতে পারবো ইনশাল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশে পাশে কোনো বাসাই থাকার ব্যবস্তা করে দিতে পারলে আমি ক্ষুদ্র ব্যবসা করে পরিবারের পাশে দাঁড়াতাম। আমি বাসার ছেলেমেয়েদের বাংলা, ইংরেজী, গণিত, আরবি পড়িয়ে দিবো। বিনিময়ে আমাকে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্তা করে দিবে। আমার ভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষীকা, বড়ভাই-বোন, ছোট ভাইবোন, সহপাঠীরা কেউ এই সুযোগ দিতে পারলে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার নাম্বারঃ ০১৭০৪৯৪৩৯৯৫; ০১৮৩৯৮৯২৩১০।

জীবনের চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এসে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েও হতাশা ছোয়নি বাচ্চুকে। জীবনের কাছে পরাজিত হতে চান না ২৩ বছর বয়সী এই উদ্যমী তরুণ। এখন আর পরাজয়ের গ্লানি নয়, একটু আশার আলো নিয়ে বাঁচতে চান তিনি। চান পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। তাদের দারিদ্রের অন্ধকার মাখা চোখে একটু আশার আলো হতে চান তিনি।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে বাচ্চু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এতোদিন আমি মোটামুটি কিছু করে চলতে পেরেছি। প্রতিকূলতার জন্য মানুষ দেখছি আত্মহত্যা করে। কিন্তু আমি সেটা করবো না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, বড় ভাই-আপু এবং সাবেকরা আছেন। তারা থাকতে আমি আত্মহত্যা করবো কেন? এজন্যই আমি সবাইকে জানাতে পোস্ট করেছি। যাতে করে তারা আমার সমস্যাটা জেনে সহয়তায় এগিয়ে আসতে পারেন। এতে করে আমি আমার পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে পারবো।

তিনি বলেন, ২৩ বছর বয়স আমার। আমার অসুস্থ বাবা এখনো এতো বড় বড় গাছে উঠে, যেটা ভাবলে আমি আঁতকে উঠি। আমি থাকতে আমার বাবা এতো বড় কষ্টের কাজ করবেন এটা আমি মানতে পারি না। খুব কষ্টে মাঝে মাঝে নীরবে কাঁদি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা বিষয়টি জেনেছি। হলের আবাসিক শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়েছি ছেলেটার সাথে কথা বলতে। দেখি আমরা কতদূর করতে পারি।


সর্বশেষ সংবাদ