তোকে শিবিরের মামলা দিব, দেখি কেমনে বিসিএস ক্যাডার হইস!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুয়েল খান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুয়েল খান  © সংগৃহীত

জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে নটরডেম কলেজে লেখাপড়া করা জুয়েল খান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থীকে খ্রিস্টান/নাস্তিক অপবাদ দিয়ে তার পরিবারকে সমাজচ্যুত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চার মাস ধরে ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের কাউকে সমাজের কারও সাথে মিশতে দেওয়া হয় না। সমাজের সবাইকে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই ছাত্রের বিসিএস ক্যাডার হওয়া ঠেকাতে শিবিরের অভিযোগ দিয়ে মামলা দায়েরের হুশিয়ারিও দেয়া হয়েছে।

এ ঘটনার তদন্তে গিয়ে সত্যতাও পেয়েছে পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার তারফপুর ইউনিয়নের পাথালিয়াপাড়া গ্রামে। কারা এ ঘটনায় জড়িত এবং বর্তমান ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের কি অবস্থা— এ নিয়ে রবিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। 

জুয়েল খান জানান, বাড়ির সীমানা নিয়ে আমার পরিবারের সঙ্গে চাচা আবদুর রশিদ খানের ছেলে শরিফুল ইসলামের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। এই বিরোধের জের ধরে গত ১ মে শরিফুল ইসলামের লোকজন লাঠিসোটা ও লোহার রড নিয়ে বাড়িতে এসে পরিবারের সদস্যদের মারপিট করে। শরিফুল ইসলাম প্রথমে লাঠি নিয়ে আমার উপর আঘাত করে।

তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে স্থানীয় মসজিদের অনারারি মুয়াজ্জিন মাসুদ মিয়া শরিফকে সহযোগিতা করে। আমি সরে গেলে লাঠির আঘাত আমার নানির গায়ে পড়ে। উনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তাকে স্থানীয় মেডিকেলে চিকিৎসা করানো হয়। মূলত এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাকে খ্রিস্টান/নাস্তিক অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের এই শিক্ষার্থী হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলে থাকতেন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার তারফপুর ইউনিয়নের পাথালিয়াপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে তিনি। ৪০তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছেন। 

রাজধানী ঢাকার খ্রিস্টান মিশনারী পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জুয়েল খান। স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন মাসুদ মিয়া প্রথমে তাকে নাস্তিক/খ্রিস্টান বলে অপবাদ দিয়েছে জানিয়ে জুয়েল খান বলেন, মাসুদ মিয়া প্রথমে আমাকে খ্রিস্টান/নাস্তিক বলে অভিযোগ করে।

তিনি বলেন, ‘মাসুদ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তুই খ্রিস্টান কলেজে (ঢাকার নটরডেম কলেজ) লেখাপড়া করেছিস। এ ছাড়া তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় লেখাপড়া করেছিস। নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বাংলায় লেখাপড়া করে তারা নাস্তিক। তুইও নাস্তিক।’

এ সময় নাস্তিকের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুমকি দেন তিনি। এ ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন শরিফুল ইসলাম, আবদুল বাছেদ মিয়া, রমজান আলী, আবদুল লতিফ, তারিকুল ইসলাম ও লিটু আনাম। এ ঘটনায় শরীফুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে ১৯ জনের নামে মির্জাপুর থানায় মামলা করেছেন জুয়েল খান।

এ মামলায় তিনিসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ১১ জন ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন। মামলাসহ ঘটনার সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ নামে একটি সংগঠন এগিয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে জুয়েল খান বলেন, ‘এ ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চকে জানালে জুলিয়াস সিজার তালুকদার আমার সাথে যোগাযোগ করেন। নিরাপত্তা মঞ্চের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করছেন আমার হলের এক ছোট ভাই তানভীর ও নারায়ণগঞ্জ পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো: জুয়েল রানা সার্বিক বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন। তিনি মির্জাপুর থানা পুলিশকে সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করার অনুরোধ করেছেন।

মামলা করার পর কোন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা করার পর তারফপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল বাছেদ মিয়া আমাকে বলেন, তুই আমাদের ১৯ জনের নামে মামলা দিয়েছিস। আমরা ১৯ জন তোদেরকে মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করাবো। তোকে শিবিরের মামলা দিব। দেখি তুই কেমনে বিসিএস ক্যাডারে হইস!’

ওই গ্রামের বাসিন্দারা জানান, জুয়েলের পরিবার সমাজের কাউকে মানে না। তাছাড়া জুয়েলের বাবা মসজিদ সম্পর্কে কটাক্ষ করে কথা বলেন এবং মসজিদে তাদের নির্ধারিত হারে ধরা অনুদানের টাকাও দেন না। যে কারণে সমাজের মুরব্বিরা তাদের সমাজচ্যুত রাখার কথা বলেছে।

এ বিষয়ে জুয়েল খান বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। আমাদের মসজিদের ইমাম হলো আবদুল বাছেদের বোনের জামাই। তার নাম আব্বাস আলী। তিনি গত তিন ঈদের নামাজে ভুল করছেন। একবার আমার বাবা (মফিজুল ইসলাম) তাকে ফান করে বলেন, কিরে ঈমাম সাহেব! নামাজ পড়ানোর সময় মন কোথায় থাকে? হাদিয়ার দিকে থাকে নাকি!’

‘এ কথা বলার কারণে মসজিদ নিয়ে কটাক্ষের অভিযোগ আনা হয়েছে। নিয়মিত মসজিদে চাঁদা দেয় আমার পরিবার। উল্টো আমাদের সমাজ থেকে বের করে হুমকি দেওয়ার সময় সমাজ থেকে পাওনা বাবদ ১২০ টাকা দিতে চাইলে আমার বাবা বলেন, এ টাকা আমার দরকার নেই।’, যোগ করেন তিনি।

এ ঘটনার ব্যাপারে মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর মিলে জুয়েলের পরিবারকে খ্রিস্টান অপবাদ দিয়ে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়। বিষয়টি খুবই অমানবিক। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


সর্বশেষ সংবাদ