ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা ভিত্তিহীন

ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল যৌক্তিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ নিয়ে কারো সন্দেহ নেই, সন্দেহের অবকাশও নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে বোদ্ধা মহলে দশকের পর দশক ধরে যে বিতর্কটি চলে আসছে, তা হলো— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নাকি এটা কথিত উপাধি; কিংবা ঢাবি এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছিল, এখন নেই। 

সময়ের ব্যবধানে বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহও দিগুণ থেকে বহুগুণ বেড়েছে। সপ্তাহখানেক পরেই (১ জুলাই) শতবর্ষে পা রাখতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া ‘ঢাবি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নাকি ‘না’ এমন প্রশ্নে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের পুরনো টকশো (নিচে ভিডিও দেওয়া হলো) ভাইরাল হয়েছে। যেখানে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড উপাধিকে ‘বদনাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। সবমিলিয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বিতর্কিটি হঠাৎ করেই আলোচনায় এনেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক।

ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনোদিনও প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছিল না। এটা একটা বদনাম। এই কথাটা যিনি বলে গেছেন, অক্সফোর্ড সম্পর্কে তার কোনো ধারনাই নেই। তিনি বলেন, অক্সফোর্ডের বয়স যখন চারশ’/পাঁচশ’ বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স তখন ১২ বছর। কীভাবে দুটোর তুলনা হয়? বলা যেতে পারে, আমরা এখন অক্সফোর্ডের দিকে যাচ্ছি।

ড. মীজান আরো বলেন, ‘কার্জন হলের কয়েকটি গম্বুজ অক্সফোর্ডের আদলে তৈরি। সে কারণে এটাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এটি অক্সফোর্ডের সঙ্গে তুলনীয় ছিল না; কেউ একজন বদনাম দিয়ে গেছে।’

এর আগে এক সেমিনারে জবি উপাচার্য বলেছিলেন, যখন এটাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়; তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ছিল ৫-৬ হাজার। আর শিক্ষক ছিল ৬৫-৬৬ জন। এমন বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা যায়?

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বিষয়টি সত্য নয়। এটা কথিত কথা। দলিলপত্রের কোথাও লেখা নেই। এটা হওয়ার কোন কারণও নেই। এটা লোকে বলে। আর বলতে বলতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

তবে কি লোকমুখের বক্তব্যেই ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লেখা একাধিক গবেষণাগ্রন্থ তথা সরদার ফজলুল করিমের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’ এবং সৈয়দ আবুল মকসুদের লিখিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’— বই দুটিতেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে বাংলা পিডিয়াতে উল্লেখ আছে, ‘১৯২১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণে এটি স্থাপিত হয়। সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হবার প্রেক্ষাপটে এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে স্বীকৃতি পায়।’

তবে এমন তথ্য উড়ে যায় যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামের বক্তব্যে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো এ অঞ্চলের পুরনো ও প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এই অঞ্চলে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে কোন আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাও পরিপূর্ণ আবাসিক ছিল না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থার জন্য কলেজ রয়েছে; তেমনি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল রয়েছে। এছাড়া আর কোন মিল নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ে বলা হয়েছিল— এই প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থীই হলে থাকবে। উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়। আসলে এর কোন দালিলিক প্রমাণ বা ভিত্তি নাই।

তিনি আরো বলেন, আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন শুনতাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হলো এশিয়ার বৃহত্তম হল; আর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হলো এশিয়ার বৃহত্তম রেলওয়ে স্টেশন। এই কথাগুলো যেমন ভিত্তিহীন, তেমনি ঢাবিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলাটাও ভিত্তিহীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কিনা— তা নিয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রশ্নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশ্বের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের বক্তব্য হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর অন্য কোথায় নাই। তার ভাষ্য, যেখানে দেশের সরকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে থাকে; সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে অবদান রেখেছে। এমনটা সাধারণত হয় না।


সর্বশেষ সংবাদ