যে ঈদ শেখায়—লোভ আর অহংকার বিসর্জনেও আছে আনন্দ
ঈদ মানেই শুধুই আনন্দ নয়—পবিত্র ঈদুল আজহা যেন এক আত্মিক শিক্ষার পাঠশালা। এটি ত্যাগ, সহানুভূতি ও আত্মশুদ্ধির এক নিবিড় অনুশীলন, যেখানে বাহ্যিক কোরবানির আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক গভীর আত্মত্যাগের সৌন্দর্য। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর শ্রদ্ধাবনত আত্মবিসর্জনের স্মরণে উদযাপিত এই উৎসব প্রতি বছরই মুসলিম হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে মানবিকতার অনন্য বোধ।
এই ঈদ উদযাপন কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা হয়ে ওঠে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য একটি আয়নার মতো—যেখানে প্রতিফলিত হয় মানুষ কতটা মানবিক, কতটা সংবেদনশীল। আর এই উপলব্ধিগুলো যেভাবে তরুণ প্রজন্মের ভাবনায় প্রতিফলিত হয়, তা আমাদের দেয় আশার আলো, দেয় ভবিষ্যতের মানবিক সমাজ গঠনের আভাস।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের শিক্ষার্থী সানি আহমেদ স্মরণ করেন তাঁর শৈশবের ঈদ। “গরুর হাট মানেই ছিল রোমাঞ্চ, পারিবারিক bonding-এর এক দারুণ সময়। গরু কেনা, তাকে আদর করা, আর ঈদের দিন কোরবানির সময় চোখের জল—এসবই ছিল প্রকৃত আত্মত্যাগের অনুভব।”
কিন্তু এখন? “আজকাল সেই হাটও ডিজিটাল হয়ে গেছে। ভিডিওতে দেখি ‘সাদা বাবু’ নামের গরু, ইনবক্স-প্রাইস। আনন্দ আছে, কিন্তু কোথায় যেন ছেঁকে যায় আবেগটা,” বললেন সানি। তাঁর কণ্ঠে যেন কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া স্পর্শ ও সৌন্দর্যের জন্য এক মৃদু হাহাকার।
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান মনে করেন, ঈদের আনন্দ হোক সবার জন্য। “আত্মত্যাগ মানে শুধু পশু জবাই নয়, বরং নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সমাজের দরিদ্র, অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।” তাঁর কথায় ফুটে ওঠে ঈদের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রসারিত পরিধি।
আরও পড়ুন: ঈদের দিনেও দায়িত্বের প্রহরায়— ‘ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করে, আমি ফিরব বলে, কিন্তু পারি না’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এমদাদুল হক দূর্জয় বলেন, “ঈদ মানেই প্রিয়জনের টানে শহর থেকে গ্রামে ফেরা। কেবল আনন্দ নয়, এটা এক ধরনের আত্মিক পরিশুদ্ধির উপলক্ষ।” তিনি মনে করেন, “যখন আমরা নিজেদের ভেতরের অহংকার, লোভ, পাশবিকতা বিসর্জন দিই—তখনই ঈদের প্রকৃত অর্থ পূর্ণ হয়।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সেজু আক্তার তুলে ধরেন কোরবানির ধর্মীয় তাৎপর্য ও সামাজিক গুরুত্ব। “মাংস বণ্টন, চামড়া দান—এসবের মধ্যে নিহিত আছে সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ। যদি প্রতিটি মানুষ অন্তর থেকে তা উপলব্ধি করত, তবে সমাজটা আরও বেশি মানবিক হতো।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম স্পষ্ট প্রশ্ন ছুড়ে দেন আমাদের বিবেকের কাছে। “আমরা কি সত্যিই সবাইকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করি? পথশিশু, ছিন্নমূল মানুষ, নিম্নআয়ের পরিবার—তাদের কি ছুঁয়ে যায় আমাদের আনন্দ?”
তাঁর আবেদন হৃদয়ছোঁয়া—“ঈদ হোক সকলের জন্য। কোরবানি হোক মানবিকতার প্রতিচ্ছবি, শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে সীমাবদ্ধ না থেকে, বাস্তবে অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর সাহসিকতায় রূপ পাক।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা বলেন, “ঈদুল আজহা আমার কাছে শুধু উৎসব নয়, বরং এক মানবিকতার শিক্ষাকেন্দ্র। পরিবারকে সময় দেওয়ার এই সুযোগটা আমাকে মানসিকভাবে প্রশান্ত করে তোলে। কোরবানির উৎসব যেন আত্মিক যোগাযোগেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।”
এই তরুণদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে ঈদুল আজহার প্রকৃত মর্মবাণী—তাৎপর্যপূর্ণ আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ সহানুভূতি, আর সমাজ বদলের জন্য সামান্য একটু ভালোবাসা। তারা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ঈদ মানে কেবল উৎসব নয়, বরং দায়িত্ব, অনুভব, এবং ভেতর থেকে বদলে যাওয়ার একটা সুযোগ।
এই ঈদ হোক অন্তরের পবিত্রতা অর্জনের এক উপলক্ষ। ঈদ হোক সকলের, সকল শ্রেণি-পেশার, হাসি ছড়িয়ে যাক প্রতিটি মুখে। ঈদ মোবারক।