২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫৭

জাবিতে খুন হওয়ার পর উঠে আসছে শামীমের অত্যাচার-নিপীড়নের নানা তথ্য

জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা  © সংগৃহীত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পর বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিচার চাইছেন সবাই। দোষীদের শাস্তির দাবি উঠেছে সর্বত্র। শামীম মোল্লার এমন নিষ্ঠুর পরিণতি নিয়ে কথা বলছেন সাবেক শিক্ষার্থীরাও। তাদের ভাষ্য, অত্যাচারের সব সীমা পার করেছিলেন শামীম। অত্যাচারিত হয়ে নিজেও প্রাণ হারালেন।     

ঘটনার বিবরণে জানা হেছে, বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৫ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় শামীমকে দেখতে পান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা তাকে মারধর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান। পরে প্রক্টরিয়াল বডি আশুলিয়া থানা পুলিশকে জানালে তাকে আটক করে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

বাবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌষ্য কোটায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান শামিম মোল্লা। তারপর জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদ রাসেলের সঙ্গে সখ্যতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দিনে দিনে বঙ্গবন্ধু হলের এক আতঙ্কের নামে পরিণত হন। 

শামীম মোল্লার মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম ব্যাচের  শিক্ষার্থী মাহবুব আলম তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, বাবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌষ্য কোটায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান শামীম মোল্লা। তারপর জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদ রাসেলের সঙ্গে সখ্যতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দিনে দিনে বঙ্গবন্ধু হলের এক আতঙ্কের নামে পরিণত হন। 

চারজনের রুমে একাই রাজকীয়ভাবে থাকতেন। চলাচলের জন্য প্রচলিত হলের সিঁড়ি ও রুট ব্যবহার না করে জানালা ভেঙে মসজিদের ছাদের ওপর দিয়ে আলাদা চলাচলের রাস্তা করেছিলেন। এ পথে কোনও জুনিয়র যদি তাকে সালাম না দিতো, তাহলে ডাক পড়তো তার রুমে। তারপর চলতো অকথ্য নির্যাতন। 

আরও পড়ুন: লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে জাবিতে বিক্ষোভ মিছিল 

তিনি একটি প্রাইভেট কার ব্যবহার করতেন। সবসময় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। মূলত হলে বসে জাবির পুরো মাদক সিন্ডিকেট এবং সাভার-আশুলিয়ার জমি দখল, ঝুট ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। রাত হলেই হলের সামনে নানা রঙের গাড়ি আসতো। তারা সোজা চলে যেতেন শামীম মোল্লার রুমে। কথিত আছে, রাত হলে তার রুমে বসতো মাদকের আসর। এছাড়া হলে একটি জার্মান শেফার্ড কুকুর পালতেন। 

তিনি আরো বলেন, আমি সাংবাদিক সমিতির সেক্রেটারি ও সভাপতি থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে যত মানুষের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ পেয়েছি, তাঁদের সবাই যদি শামীমকে একটা করে টোকাও দেয়, তাতেও তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু হয়ত আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, দু-একটি ঘটনার নিউজ হলেও বাকিগুলোর হয়নি কেন? সোজা কথা ভয়ে হয়নি। যারা নির্যাতনের শিকার হতেন, তারা মুখে অভিযোগ দিলেও নিউজ হোক সেটা চাইতেন না। আরও নির্যাতনের শিকার হতে পারেন এই ভয়ে। 

গত ১৫ জুলাই রাতে ভিসি বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অন্যতম একজন হলেন শামীম মোল্লা। সেদিন তাদের পেট্রোল বোমা মারতেও দেখা গেছে। হামলার পরে যখন তারা খিচুড়ি খাচ্ছিলেন, তখন ছাত্রলীগ সভাপতি সোহেল আহমেদকে উদ্দেশ্যে করে বলছিলেন- গুলি কম হয়ে গেছে। আরও গুলি করা লাগতো।

আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার বিষয়ে মাহবুব আলম বলেন, ১৫ জুলাই ভিসির বাসভবনের সামনে হামলার ঘটনায় অভিযোগ আছে, সেদিন সাধারণ সম্পাদক লিটনের অনুরোধে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে সাভার থেকে পিকআপে করে টোকাই নিয়ে আসেন তিনি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু হলে পেট্রোল বোমা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ওপর নিক্ষেপ করে এবং নিজের পিস্তল থেকে গুলি করেন বলেও অভিযোগ আছে। 

আরও পড়ুন: জাবিতে পিটিয়ে হত্যা: ধামরাইয়ের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি আটক

২০২১ সালের ৫ আগস্ট মাদক কারবারের বিরুদ্ধে কথা বলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক ড. মনসুর আলীকে গুলি করেছিলেন শ্যুটার শামীম। তবে গুলিটি শিক্ষকের গায়ে না লেগে নিজ অনুসারীর পায়ে লাগে। এ তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, শামীম ‘নিকৃষ্ট’ ছিল এটা যেমন সত্য, তাকে মব জাস্টিস করে মেরে ফেলাটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এটি জুলাই বিপ্লবের পরিপন্থি। তবে এখানে একটা কথা, এ অবস্থায় তিনি ক্যাম্পাসে আসলেন কেন? 

মাহবুব আলমের ভাষ্য, ছাত্রলীগের এমন নেতাদের তালিকা করলে শামিমের নাম থাকবে সবার প্রথমে। তাই সবার প্রচুর ক্ষোভ আছে তার ওপরে। এ অবস্থায় তার ক্যাম্পাসে আসাটা রহস্যজনক। ভাল থাকুক প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর। আর কোনও লাশ দেখতে চাই না। কেউ অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে বিচার হোক। মেরে ফেলা কোনও সমাধান নয়।

এ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা দীর্ঘ ৩৬ দিন যাবত দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমরা এখনও স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে পারিনি। যে শামীম মোল্লাকে গণপিটুনি  দিয়েছে, তিনি সত্যিই একজন সন্ত্রাসী ছিলেন, ছাত্রলীগ করতেন। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী সংগঠন। গত ১৫ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অন্যতম সে। তাকে গণপিটুনি দিলে পুলিশের হেফাজতে মারা গেছেন। কিন্তু আমরা শেখ হাসিনা আমলের ফ্যাসিবাদের নতুন ধরনের রুপায়নের জন্য রক্ত দিইনি।

আরো পড়ুন: জাবিতে শামীম হত্যা: সমন্বয়কসহ ৮ শিক্ষার্থীর নামে মামলা

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, গত ১২ বছরে ছাত্রলীগের অপকর্ম করা নেতাদের মধ্যে শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা ছিলেন অন্যতম। ১৫ জুলাই যখন ভিসির বাড়িতে হামলা হয়, ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে লোক এনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অন্যতম সে। গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে এখনও শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি।

এ মুহূর্তে তার ক্যাম্পাসে আসা রহস্যজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে তিনি মাদক সিন্ডিকেট চালাতেন। তারা তাকে কৌশলে নিয়ে আসে। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে ধরা পড়েন। শামীম ও তার অনুসারীরা আমাকে বিভাগ থেকে তুলে নিয়ে রসায়ন বিভাগের সামনে মেরেছিল ২০১৫ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী তার হাতে মার খেয়েছে।