০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:৫০

কেমব্রিজে পিএইচডি, অনন্য উচ্চতা গবেষণায়— নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন রাবি ‍ভিসি

অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব  © টিডিসি ফটো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন উচ্চশিক্ষালয়টির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৫তম উপাচার্য অধ্যাপক নকীব পদার্থবিজ্ঞানের একজন অন্যতম সেরা গবেষক। দেশ ছাড়িয়ে খ্যাতি ছড়িয়েছেন বিদেশের মাটিতেও। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিশেষ অবদান রাখায় পেয়েছেন দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। বিশিষ্ট এই গবেষক পিএইচডি করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সম্প্রতি এই উচ্চশিক্ষালয়টির সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ পাওয়ার পর অনন্য উচ্চতা গবেষণার জন্য তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন নেটিজেনদের।

বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব ১৯৭০ সালে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী বোর্ড থেকে ১৯৮৭ সালে এসএসসি ও ১৯৮৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে বিএসসি (অনার্স) ও ১৯৯৩ সালে এমএসসিতে (মাস্টার্স) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন। শুধু অনার্স-মাস্টার্সেই নয় শিক্ষাজীবনে সকল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগ ও প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন। কমনওয়েলথ স্কলারশিপে ২০০৩ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

আরও পড়ুন: রাবির নতুন ভিসি ড. সালেহ হাসান নকীব, কে এই অধ্যাপক? 

তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের কার্বন্ডেল শহরে অবস্থিত অন্যতম প্রধান উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট হিসাবে অধ্যয়ন করেন। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল গবেষক ও সহযোগী হিসেবে আছেন। ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন-এ অবস্থিত নিউজিল্যান্ডের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাকডিয়ারমিড ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভ্যান্সড ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড ন্যানোটেকনোলজি’-এর একজন পোস্টডক্টরাল গবেষক তিনি। এছাড়া ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিজিটিং রিসার্চার স্কলার ছিলেন।

শিক্ষকতা জীবন ও পুরস্কার-স্বীকৃতি
অধ্যাপক নকীব ১৯৯৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০১১ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। গবেষণায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অধ্যাপক নকীব বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ইতালির দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর একজন ফেলো এবং বাংলাদেশে বিজ্ঞানীদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত 'বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি’রও একজন নির্বাচিত ফেলো। যা একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ সম্মান। একজন বিজ্ঞানীর দেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে অসাধারণ অবদানের জন্য এটা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ থেকে পদার্থবিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে ‘তরুণ বিজ্ঞানী’ হিসেবে ২০০৮ সালে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন। ‘আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স’ প্রতিষ্ঠানটিতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সহযোগী সদস্য হিসেবে ছিলেন। যা এক ধরনের বৈজ্ঞানিক সম্মাননা। 

ক্যারিয়ারের প্রাথমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান ও গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৭ সালে পদার্থবিজ্ঞান শাখায় একজন তরুণ গবেষক হিসেবে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। পরে ২০১৬ সালে পদার্থবিজ্ঞান শাখায় একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী হিসেবে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক’ লাভ করেন; যা সিনিয়র বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সম্মানজনক পুরস্কার। 

গবেষণায় তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় হলো সুপার কন্ডাকটিভিটি এবং কম্পিউটেশনাল ফিজিক্স। ২০২০ সালে স্কোপাস তালিকাভুক্ত জার্নালগুলোতে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধ নিয়ে অধ্যাপক নকীব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গবেষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ডিনস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এ ছাড়াও ২০০৮ সালে টাওয়াস ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১১ সালে রাজ্জাক-শামসুন ফিজিক্স রিসার্চ পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০২১ সালে দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স টোয়াসের সদস্য হিসেবে পদ পেয়েছিল অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। রাবির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো অধ্যাপক হিসাবে তিনি এ সম্মানিত পদটি পেয়েছিলেন। 

পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিত শাখার সেরা গবেষক হিসেবে ২০১৮ ও ২০২১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ থেকে ডিন’স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত সেরা পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাপত্রের জন্য ২০১১ সালে ‘রাজ্জাক-শামসুন পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা পুরস্কার’ অর্জন করেন এই অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সেরা গবেষক হিসেবে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে ‘এস এন নাহার পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা পুরস্কার’ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংলাপ চট্টগ্রামে, বর্জনের আহ্বান সমন্বয়কদের 

২০১৫ ও ২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের সেরা শিক্ষক হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করেন। এটি একজন শিক্ষকের শিক্ষাদানের দক্ষতা এবং ছাত্রদের উপর তাঁর ইতিবাচক প্রভাবের প্রতিফলন। ২০২০ সালে স্কোপাস তালিকাভুক্ত জার্নালগুলোতে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধ নিয়ে অধ্যাপক নকীব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গবেষক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় অধ্যাপক নকীব এই দেশের একজন সেরা গবেষক। তিনি এই পর্যন্ত স্কপাস ইনডেক্স বিভিন্ন জার্নালে ১৭৫টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের বনেদি জার্নাল হিসাবে পরিচিত এবং আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ বি’ এবং ‘ন্যাচার পাবলিশিং’ থেকে প্রকাশিত ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে অনেকগুলো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। 

এছাড়া তাঁর গবেষণা প্রবন্ধগুলো বিশ্বের বিভিন্ন গবেষকের বিভিন্ন প্রকাশিত প্রবন্ধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকভাবে (গুগল স্কলার সাইটেশন: ৪৬২৩) উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি এই পর্যন্ত প্রায় ৪০ জনের অধিক ছাত্রের (এমএসসি, এমফিল ও পিএইচডি) গবেষণা কাজের তত্ত্বাবধান করেন। 

শিক্ষকতা ও গবেষণার বাইরে অবদান
এই অধ্যাপক শুধু নিজের গবেষণা নিয়েই থাকেন না, সেইসঙ্গে বিভিন্ন কাজেও নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ ২০২৩ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে, যেখানে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। গত ২০১৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে, যেখানে তিনি আয়োজক কমিটির সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক প্রতিবছর আয়োজিত কনফারেন্স তিনি বরাবর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দুইটি স্বনামধন্য গবেষণা জার্নাল ‘জার্নাল অব দি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস’ এবং ‘জার্নাল অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’র এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালের রিভিউয়ার হিসেবে তিনি অবদান রাখেন। এছাড়া তিনি বিভাগীয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াড আয়োজনের আয়োজক এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে আয়োজিত বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজনের একজন সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।