পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দিয়ে ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া, বাসার কাজ করান প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা
- মুহাইমিনুল ইসলাম, ঢাবি
- প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০১:০৭ PM , আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪, ১০:১০ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. মো. তানভীর আলীর আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রতিষ্ঠানটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দিয়ে ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া করানো, বাসার কাজ করানোসহ আরও বিভিন্ন অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ঠ হয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন প্রতিষ্ঠানটির অনেকে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে একে চক্রান্ত বলে দাবি সিএমও তানভীর আলীর।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোর বদলে তিনি নিজের বানানো লোগো ব্যবহার করেন সিএমও তানভীর আলী। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে প্রচলিত অফিস সিস্টেমের বিপরীতে নিজের ইচ্ছামতো আদেশ জারি করেন। তিনি বিভিন্ন স্টাফ ও ড্রাইভারদেরকে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর), পদোন্নতি আটকানোর ভয় ও ওভারটাইমের লোভ দেখিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা বাসার কাজে ব্যবহার করান।
এখন আন্দোলনের কারণে বিষয়টি স্তিমিত হয়ে আছে। আন্দোলন পরবর্তী তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। -অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ
অভিযোগ রয়েছে, ডা. তানভীর আলী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। তিনি কর্মচারীদেরকে দিয়ে ব্যক্তিগত কাজও করান। এসবে তারা অস্বীকৃতি জানালে শোকজ করেন এবং মুচলেকা নেন। কয়েকদিন আগেও রফিক উল্লাহ নামে এক কর্মচারীর (ট্রান্সপোর্ট ক্লিনার) সঙ্গে ঘটেছে এমন ঘটনা।
এর আগেও মাজেদুল ইসলাম নামে এক ড্রাইভারের উপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ প্রয়োগের ফলে তিনি হার্ট স্ট্রোক করেন। পরে তার হার্টে রিং পরানো হয়েছে। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যেকোনো বিষয়ে তার সাথে কথা বলতে গেলেই তিনি সবার ভিডিও করে রাখেন এবং রিমান্ডের মতো জেরা করে জটিলতা তৈরি করেন।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, সিএমও মেডিকেল সেন্টারের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেই রূঢ় আচরণ করেন। তার আচরণে আমরা বিরক্ত। একটু কিছু হলেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে চাকরি খেয়ে দেওয়া ও অবসরে পাঠানোর হুমকি দেন। আমি নিজেও এসবের ভুক্তভোগী। এখানে এ পর্যন্ত আমি চারজন সিএমও দেখেছি। কিন্তু তার মতো এমন ব্যক্তিত্বের লোক দেখিনি। তার আচরণে মাঝেমধ্যে মন চায়, চাকরিটা ছেড়ে চলে যাই।
এসব অভিযোগে সিএমও ডা. তানভীর আলীকে নিয়ে মেডিকেল সেন্টারের অভ্যন্তরে এখন রীতিমতো তোলপাড় চলছে। এতে করে দিনদিন বেসামাল হয়ে পড়ছে মেডিকেলে সেন্টারটি। ফলে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মেডিকেল সেবা গ্রহণ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এখন আন্দোলনের কারণে বিষয়টি স্তিমিত হয়ে আছে। আন্দোলন পরবর্তী তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। -ডা. মো. তানভীর আলী
এদিকে, সম্প্রতি সিএমও ডা. তানভীরের স্বেচ্ছাচারিতা ও মানসিক নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ট্রান্সপোর্ট ক্লিনার রফিকউল্লাহ। এরপর তিনি ডা. তানভীরের বিরুদ্ধে গত ১১ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং হেলথ বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এতে তিনি উল্লেখ করেন, আমি ট্রান্সপোর্ট ক্লিনার পদে থাকার পরও প্রধান মেডিকেল অফিসার আমাকে দিয়ে উনার ছেলেকে স্কুল-কোচিংয়ে পাঠান। কখনো কখনো বাসার বাজারও করান। গাছে পানি দেয়ান। ওনার পারিবারিক কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে উনি আমাকে শোকজ ও মুচলেকা দিয়ে আমার ওভারটাইম কেটে দেন।
নামাজ পড়তে গেলে তার সাথে গিয়ে মসজিদে নামাজের বিছানা বিছিয়ে দিতে হয়। আবার নামাজ পড়া হলে জায়নামাজ উঠিয়ে নিয়ে আসতে হয়। তার ব্যক্তিগত গাড়ি প্রতিদিন পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ও মুছে দিতে হয়। তার বাচ্চাকে বিকেলে সার্কিট হাউজ মসজিদে আরবি পড়ার জন্য নিয়ে গিয়ে প্রতিদিন বাসায় না দিয়ে আসা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়।
ভুক্তভোগী রফিকউল্লাহ আরও বলেন, মেডিকেল সেন্টারের অনেককেই তিনি মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে অসুস্থ করে ফেলেছেন। সবাই তার ব্যবহারে আতঙ্কগ্রস্ত। গোপন প্রতিবেদনের ভয়ভীতি দেখিয়ে উনি তার ব্যক্তিগত কাজ হাসিল করেন। সর্বশেষ আমি শোকজের উত্তর দিলে তিনি অফিস থেকে মুচলেকা লিখে আমাকে স্বাক্ষর করতে বললে আমি মানসিক যন্ত্রণায় এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বুকের ব্যথায় আমার সহকর্মীরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানেও সিএমও তানভীর আমার চিকিৎসায় বাধা তৈরি চেষ্টা করেছেন বলে জানাতে পেরেছি।
তবে চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. মো. তানভীর আলীর দাবি, মেডিকেল সেন্টারে আগে যে ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা ছিল এখন তার চেয়ে আরও অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে ৪০ প্রকারের ওষুধ রয়েছে, প্রত্যেকের সমস্যা অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়।
এর আগে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদের কাছে ডা. তানভীরের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট অনুমোদিত ওভারটাইম বাতিলের প্রতিবাদে আরও একটি লিখিত অভিযোগ দেন মেডিকেল সেন্টার অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা।
মেডিকেল সেন্টারে আগে যে ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা ছিল এখন তার চেয়ে আরও অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে ৪০ প্রকারের ওষুধ রয়েছে, প্রত্যেকের সমস্যা অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। -ডা. মো. তানভীর আলী
এতে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী প্রয়োজনে জরুরি রোগী পরিবহনে ২৪ ঘণ্টা দুইটি অ্যাম্বুলেন্স ও ২ জন ড্রাইভার কর্মরত থাকেন। এতে করে কোনো অ্যাম্বুলেন্স কোনো রোগী পরিবহণ সেবায় নিয়োজিত থাকলে অপরটি জরুরি সার্ভিসের জন্য মেডিকেল সেন্টারে স্ট্যান্ডবাই থাকে। যানজট বা কোনো কারণে কোনো অ্যাম্বুলেন্স কোথাও আটকে গেলে সেখান থেকে ফেরত আসতে অনেক সময় ৩-৪ ঘণ্টা সময় বেশি লেগে যায়।
সেক্ষেত্রে সেন্টারের অবস্থিত গাড়ি অন্য জরুরি কলের জন্য ২৪ ঘণ্টা ব্যাকআপ সাপোর্ট হিসেবে থাকে। কিন্তু ডা. তানভীর আলী হঠাৎ কোন ব্যাকআপ গাড়ি না রাখার একক সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল ড্রাইভারদের সকল রকমের ওভারটাইম ডিউটি বাতিল করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি রোগী সার্ভিসের মান ক্ষতিগ্রস্ত ও নিম্নগামী হয়। এতে অনেক সময় কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে জরুরি রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দিতে পারছেন না।
এছাড়া, চলতি বছরের শুরুর দিকে ডা. তানভীর আলী দীর্ঘ এক মাস ধরে ছুটির দিনগুলোতে মেডিকেল সেন্টারের আম, কাঁঠাল, বরই, হরতকীসহ বিভিন্ন প্রজাতির অর্ধশতাধিক গাছ কেটে রাতের আঁধারে বিক্রি করে ফেলেন। পরে গাছের গোড়া তুলে মাটি দিয়ে সেই গর্ত ভরাট করে রাখেন, যাতে বোঝা না যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ক্যাম্পাসের গাছ কাটা বা ডাল ছাঁটাইয়ের জন্য আরবরি কালচার সেন্টারের অনুমতি নিতে হয়। ডা. তানভীর ওই অনুমতি চেয়েছিলেন; কিন্তু তাকে তা দেওয়া হয়নি। তারপরও তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই গাছগুলো কেটে পেলেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
জানতে চাইলে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. মো. তানভীর আলী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে তোলা এসকল অভিযোগ মিথ্যা। আমি নিয়মের বাইরে কোনো কিছুই করি না। এই মেডিকেল সেন্টারে অনেক সমস্যা আছে। আমি সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। আমি হুমকি দিয়ে কেনো কাজ করাবো? নিয়মের মধ্যে কাজ করালে যদি হুমকি হয়ে যায়, তাহলে কীভাবে হবে!
অনুমতি ছাড়া গাছকাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো অনেক আগের ঘটনা। এ বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে ভিসি স্যারের সাথে কথা হয়েছে, এখন আর কোনো সমস্যা নাই।
আমি ট্রান্সপোর্ট ক্লিনার পদে থাকার পরও প্রধান মেডিকেল অফিসার আমাকে দিয়ে উনার ছেলেকে স্কুল-কোচিংয়ে পাঠান। কখনো কখনো বাসার বাজারও করান। গাছে পানি দেয়ান। -রফিকউল্লাহ, ভুক্তভোগী কর্মচারী
তবে এ বিষয়ে ভিন্ন কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবরি কালচার সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা। তিনি বলেন, এটা বেশকিছু দিন আগের ঘটনা। সে আমার অনুমতি ছাড়ায় গাছগুলো কেটেছে। এ বিষয়টি সম্পর্কে ভাইস চ্যান্সেলর স্যারও অবগত আছেন।তিনি অতি উৎসাহী হয়ে এই গাছগুলো কেটেছেন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং হেলথ বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখন আন্দোলনের কারণে বিষয়টি স্তিমিত হয়ে আছে। আন্দোলন পরবর্তী তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।