ঢাবির জগন্নাথ হল ট্রাজেডি

চোখে পানি নিয়ে রক্তদান করেছিল শিক্ষার্থীরা, ছিল না হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ

জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতি ভবন। ইনসেটে সুনীল কুমার দাস
জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতি ভবন। ইনসেটে সুনীল কুমার দাস  © ফাইল ছবি

আজ ১৫ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস। ১৯৮৫ সালের এ দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তৎকালীন অনুদ্বৈপায়ন ভবনের টেলিভিশন কক্ষের ছাদ ধসে ৪০ জন মারা যান। নিহতদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন ছাত্র। ১৩ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও অতিথি। আহত হন শতাধিক। এর মধ্যে অনেকে পঙ্গু হয়ে যান চিরতরে। আজ সেই ট্র্যাজেডির ৩৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে।

সেদিন জগন্নাথ হলে সংঘটিত দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। এজন্য প্রতি বছর দিনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস হিসেবে পালিত হতে আসছে। আজ রোববার (১৫ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে দিবসটি। এ উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল, হোস্টেল ও প্রধান প্রধান ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে।

জানা যায়, তৎকালীন সংসদ ভবন নামক একটি ভবনের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীরা নাটক দেখতে একত্রিত হয়েছিলেন। নাটক দেখাকালীন সময়ে ভবনটির ছাদ ভেঙে শিক্ষার্থী ও অন্যদের ওপর পড়লে তখনি অনেকে মারা যান। সে দিনের ঘটনায় বেচেঁ যাওয়া এক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। তার নাম সুনীল কুমার দাস। 

তৎকালীন ওই ভবনের কাজে দায়িত্বে থাকা এ কর্মচারী বলে, ‘এটি ছিল খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। আমি তখন ভবনের  টিভি রুমের বিভিন্ন কাজ করতাম। ওটা আগে পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের জায়গা ছিল। যেদিন ঘটনাটি ঘটে, সেদিন শুকতারা নাটক চলছিল। তখন সবাই খুব নাটক দেখতে পছন্দ করত। ছাত্রদের অনুরোধে আমি টিভি রুম খুলে দেই এবং সামনে গিয়ে বসি। রাত সাড়ে ৮টা বা ৯টার সময় জোরে শব্দ হয় এবং ছাদটি পড়ে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ জগদীশ স্যারকে জানাই এবং ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে বলি। তিনি সেটিই করেন।’

আরো পড়ু: ঢাবির ভিসি হচ্ছেন অধ্যাপক মাকসুদ কামাল

ঘটনার পর পরিস্থিতি কেমন হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িকতার চরম রূপ আমি সেদিন দেখি। সবাই রক্ত দিচ্ছে। সবাই বলছে আমার ভাই মারা গেছে। কে হিন্দু কে মুসলিম, এগুলো তখন ছিল না। সবাই রক্ত দেওয়া আর হাসপাতালে নেওয়ায় ব্যস্ত ছিল। সবার চোখে পানি ছিল। শিক্ষার্থীরা তাদের দিক থেকে যতটা সম্ভব করেছিল।’

কত জন মারা গিয়েছিল জানতে চাইলে সুনীল কুমার বলেন, ‘ঘটনাস্থলেই ৩৯ জনের মতো মারা গিয়েছিল। পরে হাসপাতালে আরও তিন থেকে চার জন মারা যায়। ছাদটা একটু বাঁকা ছিল, যার ফলে আমি সামনে থাকায় বেঁচে যাই।’

‘শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িকতার চরম রূপ আমি সেদিন দেখি। সবাই রক্ত দিচ্ছে। সবাই বলছে আমার ভাই মারা গেছে। কে হিন্দু কে মুসলিম, এগুলো তখন ছিল না। সবাই রক্ত দেওয়া আর হাসপাতালে নেওয়ায় ব্যস্ত ছিল। সবার চোখে পানি ছিল। শিক্ষার্থীরা তাদের দিক থেকে যতটা সম্ভব করেছিল।’

তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, ‘ঘটনার পর আবার যখন কাজে যুক্ত হই, আমি ওখানে শুধু রক্তের গন্ধ পেতাম। আমার কাছেই হয়তো শুধু এমন মনে হতো। যেন এখনও এখানে রক্ত আছে। প্রতিবছর এ দিন এলেই ঘটনাটি আমার চোখে ভেসে ওঠে।’

নিহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন, গণিত বিভাগের অতুলচন্দ্র পাল, ভূগোল বিভাগের অনুপম সাহা রায়, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অলোক কুমার কর্মকার, সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অসীম কুমার সরকার, ফার্মেসি বিভাগের আশীষ কুমার হালদার, ফিন্যান্স বিভাগের উত্তম কুমার রায়, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের কার্তিক চন্দ্র বালা, ফলিত রসায়ন বিভাগের গোপাল চন্দ্র কর্মকারসহ আরও অনেকে।

যে ভবনে ঘটে দুর্ঘটনাটি
জগন্নাথ হলের যে ভবনটির ছাদ ধসে দুর্ঘটনাটি ঘটে, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেটিকে বলা হতো ‘পরিষদ ভবন’ বা ‘অ্যাসেম্বলি হল।’ ১০০ বছরেরও বেশি পুরোনো অডিটোরিয়ামটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের পরিষদ ভবন বা সংসদ ভবন ছিল। তাই এটি অ্যাসেম্বলি হল বা পরিষদ ভবন হিসেবে পরিচিতি পায়।

পরে নতুন পরিষদ ভবন তৈরি হলে ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবরের মর্মান্তিক ঘটনার আগে পর্যন্ত এটি জগন্নাথ হলের টেলিভিশন কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে সেদিন রাতে পুরোনো ভবনটির ছাদ ধসে পড়ে। মারা যান ৪০ জন, আহত হন শতাধিক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সে রাতটি ‘অক্টোবরের ট্রাজেডি’ হিসেবে পরিচিত। পরে জায়গাটিতে অক্টোবর স্মৃতি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ