দেড় মাসে ঢাবির ৪ শিক্ষার্থীর আত্মহনন

‘তুচ্ছ’ কারণে তারা বেছে নেন না এমন পথ

কাজী ফিরোজ, শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম, ঋতু কর্মকার ও মীর জাওয়াদ
কাজী ফিরোজ, শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম, ঋতু কর্মকার ও মীর জাওয়াদ  © টিডিসি ফটো

সর্ম্পক ভেঙে যাওয়া, পারিবারিক কলহ, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাসহ নানা কারণে হতাশায় ভুগছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। গত দেড় মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এই চিত্র শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, গত মাসে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রকাশ করা এক জরিপে চলতি বছরের ৮ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৬৬ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করেছেন বলে উঠে এসেছে।

উচ্চশিক্ষায় পড়তে আসা তরুণদের মধ্যে আত্মহনন বেড়ে যাওয়ায় ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। মনোবিদরা বলছেন, যখন কারও মানসিক সংকট এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে সে নিজেকে শেষ করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়। ‘তুচ্ছ’ কারণে কেউ আত্মহননের মতো পথ বেছে নেন না।

তাদের মতে, করোনাভাইরাসের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কেউ তীব্র মানসিক পীড়ায় থাকলে অবশ্যই একজন পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যসেবীর কাছে যাওয়া উচিৎ বলে মত তাদের।

সর্বশেষ গত রবিবার (৮ অক্টোবর) মধ্যরাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় ভাড়া বাসার ছাদ থেকে ‘লাফিয়ে পড়ে’ মীর জাওয়াদ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বন্ধুরা বলেন, মীর জাওয়াদ গত এক মাস ধরে হতাশায় ভুগছিলেন। 

এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন কাজী ফিরোজ নামে ২০১৯-২০ সেশনের এক শিক্ষার্থী। তিনি চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ঘটনার পর ফিরোজের কক্ষে তার পড়ার টেবিলের ওপর রাখা একটি প্যাডে ফিরোজের কিছু হতাশার কথা লেখা ছিল। সেই সময় তার সহপাঠীরা জানায়, প্রেমগঠিত ইস্যুর কারণে তার ভেতরে হতাশা ছিল। 

এর আগে ২১ আগস্ট সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের কক্ষে শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই সময় তার বন্ধুরা জানায়, পারিবারিক কলহ, অর্থনৈতিক কষ্ট, প্রেমগঠিত বিষয়ে হতাশা ছিল তার।    

এর দু’দিন আগে ১৯ আগস্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ঋতু কর্মকার আজিমপুরের একটি মেসে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। সেই সময় তার বন্ধু ও পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, রিতু কর্মকার দেশের বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু পরিবারের সাথে কলহ ও বন্ধুদের সাথে দূরত্ব ,ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায় তিনি আত্মহত্যা করেন। 

আরও পড়ুন: ক্যাম্পাস লাইফে প্রেমে বিচ্ছেদ হলে নিজেকে সামলাবেন যেভাবে

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রেমঘটিত টানাপোড়েন, চাকরি না পাওয়া, পড়াশোনায় পিছিয়ে যাওয়া এবং পারিবারিক সমস্যাসহ নানান কারণে আত্মহত্যা বেড়েছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পর উদ্বেগ ছড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সব সময় উদাসীন ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পার হলেও ছেলেদের ১৩টি হলসহ ২টি হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সাইকোলোজিস্ট এর ব্যাবস্থা রাখা হয়নি। টিএসসিতে শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যায় বিনামূল্যে কাউন্সেলিং সেবা দিচ্ছে ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর। কিন্তু সেটি ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর তুলনায় অপ্রতুল। 

এছাড়াও প্রতিটি বিভাগে ছাত্রপরামর্শক হিসেবে একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া আছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোনো শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত থাকলেও ছাত্র পরামর্শ কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা শিক্ষক সেই শিক্ষার্থীর খোজঁ নেয় না।   

এদিকে, সম্প্রতি ছেলেদের প্রতিটি হলে শিক্ষক হিসেবে মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলর পদে একজন করে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আহসান প্রামাণিক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের হলের অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে হতাশায় থাকে। কেউ প্রেমগঠিত বিষয়, কেউ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায় আছে। কিন্তু হলের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজ নেওয়া হয়না। এখন চারদিকে আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে জোর দেওয়া প্রয়োজন।  

তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীরা কী আত্মহত্যা করছে, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, 'তুচ্ছ' কারণে কেউ-ই আত্মহননেন পথ বেছে নেন না। আত্মহত্যার সঠিক কারণ সম্পর্কে আমরা কেউ-ই সঠিকভাবে জানি না। 

“আপাতদৃষ্টিতে ‘তুচ্ছ’ কারণগুলো প্রকৃতপক্ষে টিপ আব দা আইসবার্গ। এর ভেতরে রয়েছে গভীর মানসিক সংকট। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির মানসিক সংকট এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে সে নিজেকে শেষ করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনা সংগঠনের সময় যে কারণ আমরা খালি চোখে দেখি, তা মোটেও মুল কারণ নয়।”

শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীসহ যেকোনো মানুষ তার চারপাশে এবং নিজের ভেতরে কি হচ্ছে তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারলে, মানসিক সংকট মোকাবিলা সহজ হয়। কেউ তীব্র মানসিক পীড়ায় থাকলে অবশ্যই একজন পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যসেবীর কাছে যাওয়া উচিৎ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কোভিডের পর থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কারণ বিভিন্ন সম্পর্ক ভেঙে গেছে; মানুষের সাথে যোগাযোগ কমে গেছে। এছাড়াও আমাদের তরুণদের ভালো চাকরির অপ্রতুলতা রয়েছে। এতে করে তরুণরা হতাশ হয়ে পড়েছে। 

শিক্ষার্থীদের জন্য ২টি পরামর্শ রয়েছে উল্লেখ করে এই শিক্ষক বলেন, প্রথমটি হলো জীবনকে একভাবে চিন্তা করলে হবে না। এই চাকরিটিই লাগবে বা এই মানুষকেই লাগবে এসব এক কেন্দ্রীক চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্বাবলম্বী হওয়ার আরও অনেক উপায় আছে। সেগুলোতেও চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত সমস্যার সমাধানের জন্য শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকা। বন্ধুর সাথে শেয়ার করা, না হলে পরিবারের সাথে শেয়ার করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে শেয়ার করা। তাহলে কষ্ট দূর হবে।


সর্বশেষ সংবাদ