ভয়াল সেই কালরাতে ঢাবি পরিবারের যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন
আজ থেকে ৫২ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ। ভয়াল সেই কালরাতে অসংখ্য মানুষের রক্তস্নাত ত্যাগে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের। অপারেশন সার্চলাইটে মেজর জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে এই নারকীয় হত্যাকান্ডের শুরুতে ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮নং পাঞ্জাব, ২২নং বেলুচ, ৩২নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিলো ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এই সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্থানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং-৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং-৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং-২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে।
আরও পড়ুন: ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটেছিল?
২২নং বালুচ, ১৮ ও ৩২নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বাছাই করা একদল সৈন্য তৎকালীন ইকবাল হল (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হলে আক্রমন চালায়।প্রথমেই আক্রমন চালায় ইকবাল হলে যে হলটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রন কক্ষ এবং আন্দোলনের অধিকাংশই নেতা থাকতেন এ হলে।ছাত্ররা সাধারণ অস্ত্র দিয়ে সে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একই সঙ্গে আক্রমন করা হয় জগন্নাথ হল এবং রোকেয়া হলেও।সেখানে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড পরিচালনার পর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে পুরো ক্যাম্পাসকে পরিণত করে লাশের স্তুপে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে গণহত্যা চালানো হয়
‘গভীর রাতে প্রথমে আক্রমণ করা হয় ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল)। পাকসেনারা কক্ষে ঢুকে গুলি করে অনেক ঘুমন্ত ছাত্রকে হত্যা করে। জগন্নাথ হলেও নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। শত শত ছাত্রের লাশ সেদিন জগন্নাথ হলের সিঁড়িতে, বারান্দায় ও রাস্তায় স্তুপ হয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের হত্যার পর মাঠে গণকবর দেয়। ছাত্রীদের রোকেয়া হলেও পাকসেনারা চালায় নির্মম পাশবিক নির্যাতন।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকবাহিনীর এমন বর্বোরোচিত চিত্র তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন তার ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ বইয়ে। বইটিতে ইতিহাস বিভাগের এ অধ্যাপক আরও বর্ণনা করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনাও।
তার মতে, ২৫-২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট ৩০০ জন ছাত্র-কর্মচারী হত্যা করা হয়।
আর্চার কে ব্লাড-এর বই “The Cruel birth of Bangladesh” থেকে জানা যায় যে, ছাত্রীদের রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়।
পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, রোকেয়া হলে আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সেসময় হত্যা করা হয়।
যে কারণে টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ এবং ইতিহাসবেত্তাদের জবানী থেকে জানা যায়, অপারেশন সার্চলাইটে ঢাকা শহরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে আটটি সিদ্ধান্ত নেয় তারমধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমন। কারণ বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল ভাষা আন্দোলনই নয় পরবর্তীতে সংগঠিত সবগুলো আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রাখে। তাছাড়া পাকিস্তান সামরিক জান্তার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি ছিল আওয়ামী লীগের শক্তিকেন্দ্র হিসেবে। অসহযোগ আন্দোলনের বেশিরভাগ ছাত্রনেতাও ছিলেন এখানকারই। পাকবাহিনীর ধারণা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে থামিয়ে দিতে পারলে গতি হারাবে বাঙালিদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তাইতো অপারেশন সার্চলাইটের শুরুতেই এ ক্যাম্পাসে আক্রমন চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে শিক্ষক-ছাত্র এবং কর্মকর্তা-কর্মচারিদের।
শুরু হয় শিক্ষক হত্যাকাণ্ড
২৫ মার্চের গণহত্যার (অপারেশন সার্চলাইট) প্রথম পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে অধ্যাপক ফজলুর রহমান এবং তার দুই আত্মীয় নীলক্ষেতের ২৩ নং ভবনে নিহত হন। পাকবাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা এবং অধ্যাপক রশিদুল হাসানের (ইংরেজি বিভাগ) বাসভবন আক্রমণ করে। তাঁরা দুজনেই খাটের নিচে লুকিয়ে বেঁচে যান, কিন্তু পরবর্তীতে আল-বদর বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। ২৪ নং ভবনে বাংলা সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন। তাঁর বাসভবনে প্রবেশমুখে দুইজন আহত নারী তাদের সন্তানসহ কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রক্তের দাগ লেগে ছিলো মাটিতে। পাকবাহিনী যখন তাঁর বাসভবন আক্রমণের জন্য আসে, তখন তারা রক্তের দাগ দেখে ধারণা করে নেয় অন্য কোন ইউনিট হয়তো এখানে কাজ সমাধা করে গেছে, তাই তারা আর প্রবেশ করেনি। এভাবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিতান্ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
১২নং ফুলার রোডের বাসভবনে পাকিস্থানী আর্মি সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সায়েদ আলী নোকির বাসায় যায়। আর্মি তাকে ছেড়ে দিলেও ওই একই ভবনের ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুক্তাদিরকে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ জহরুল হক হলে (তদানীন্তন ইকবাল হল) পাওয়া যায়। ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ক ম মুনিম, যিনি সেই সময় সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বে ছিলেন, পাকিস্থানী বাহিনীর আক্রমনে আহত হন। ঢাকা হলের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আ র খান খাদিম ও শরাফত আলীকে হত্যা করা হয়। পাকিস্থানী বাহিনী জগন্নাথ হলে শিক্ষকনিবাসে আক্রমণ করে এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মির্জা হুদা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরকে লাঞ্ছিত করে।
তৎকালীন সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের আবাস জগন্নাথ হল আক্রমণের সময় হলের প্রভোস্টের বাসাও আক্রমণ করা হয়। পাকিস্থানী বাহিনী ভূতপূর্ব-প্রভোস্ট এবং জনপ্রিয় শিক্ষক, দর্শণ শাস্ত্রের অধ্যাপক জি সি দেবকে হত্যা করে, সংগে তাঁর মুসলিম দত্তক কন্যার স্বামীকেও। এর পর পাকিস্থানী বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী বাসভবনে আক্রমণ করে এবং সেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরুজ্জামানকে তাঁর পুত্র ও আত্মীয়সহ হত্যা করে। জগন্নাথ হলে প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হলের ইলেক্ট্রিসিয়ান চিত্রাবলী ও চাক্ষুস সাক্ষী রাজকুমারী দেবী জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা অধ্যাপক ঠাকুরতাকে চিনতে পারেন এবং তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কাছে একটি গাছের নিচে সমাহিত করেন। পরের সকালের বর্ণনা দিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষক ড. নূরুলউল্লা। তিনি সেই সকালের ঘটনা ক্যামেরা বন্দী করে রেখেছিলেন দূর থেকে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত জেনোসাইডের সবচেয়ে বড়ো দলিলের অন্যতম। তিনি সকাল ৭-৮টার দিকে যে দৃশ্য ক্যামেরান্দী করেন তার বর্ণনা দেন এভাবে
‘জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম, জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে আনা হচ্ছে এবং লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে। তখনই আমার সন্দেহ হয় এবং আমি ক্যামেরা অন করি।.... কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম, ছেলেগুলোকে একধারছে গুলি করা হচ্ছে এবং এক এক জন করে পড়ে যাচ্ছে। আবার কিছু সংখ্যক লোককে ধরে আনা হচ্ছে।’
জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার সাথে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকেও রাখা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়। সহযোগী হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও ছাত্রাবাসেই হত্যা করা হয়। অধ্যাপক আনোয়ার পাশার উপন্যাস "রাইফেল, রোটি, অওরাত" থেকে এ তথ্য জানা যায়। অধ্যাপক পাশা পরবর্তীতে ডিসেম্বর মাসে আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হন। তিনি তাঁর এই জনপ্রিয় উপন্যাসটি ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন ৯ মাসে রচনা করেন।
ঠান্ডামাথায় হত্যা করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের
অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদ’ কে কেন্দ্র করে। তাই, পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। অধ্যাপক ড. ক ম মুনিমের মতে, এই হলের কম-বেশি ২০০ জন ছাত্রকে পাকবাহিনী হত্যা করে।
রাত বারোটার পর পাকসেনারা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে এবং প্রথমে মর্টার আক্রমণ চালায়, সেই সাথে চলতে থাকে অবিরাম গুলি। তারা উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। সেই আঘাতে ৩৪ জন ছাত্র প্রাণ হারান। জগন্নাথ হলের কয়েকজন ছাত্র রমনা কালী বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। সেখানে ৫/৬ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কেবলমাত্র একজনের নাম পরবর্তীতে জানতে পারা যায়, তার নাম রমণীমোহন ভট্টাচার্য্য। ছাত্রদের কাছে আসা অনেক অতিথিও এই সময় প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পল, জগন্নাথ হলের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর। আর্চার কে ব্লাড-এর বই ‘‘The Cruel birth of Bangladesh’’ হতে জানা যায় যে, ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সেসময় হত্যা করা হয়।
ছাত্রদের মাঝে ভীতি সঞ্চারের জন্য সেনারা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে লাশ ফেলে রেখে যায়। এর মধ্যে শহিদুল্লাহ্ হলের পুকুর পাড়েই তারা ১০টির মতো লাশ ফেলে রেখে যায়। ২৬ মার্চ সকালে কন্ট্রোল রুম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মর্তার মধ্যে কথোপকথন নিম্নরূপ:
কন্ট্রোল: তিনশ’ই মারা গেছে, না কেউ বন্দী বা আহত হয়েছে?
উত্তর: আমি এটাই পছন্দ করি। তিনশ’ই মারা গেছে।
কন্ট্রোল: ৮৮। আমিও তোমার সাথে একমত। এই কাজটাই সহজ
জগন্নাথ হলে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন যেসব ছাত্র
হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। এরমধ্যে উপেন্দ্র নাথ রায়: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (গ্রাম: গুলিয়ারা, দিনাজপুর), কার্তিক শিল : শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (কলাখালি, বরিশাল) , কিশোরী মোহন সরকার : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (পারাগ্রাম, ঢাকা) , কেশব চন্দ্র হাওলাদার : প্রথম বর্ষ গণিত (কাঁচাবালিয়া, বরিশাল) , গণপতি হাওলাদার: রসায়ন (ঘটিচরা, বরিশাল) , জীবন কৃষ্ণ সরকার : শেষ বর্ষ রসায়ন (কুলপাতক, ময়মনসিংহ) , নণী গোপাল ভৌমিক : দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র (শ্যাম গ্রাম, কুমিল্লা) , নির্মল কুমার রায় : প্রথম বর্ষ এমকম , নিরঞ্জন প্রসাদ সাহা : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান, নিরঞ্জন হালদার: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (শিকড়পুর, বরিশাল) , প্রদীপ নারায়ন রায় চৌধুরী: প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ছাত্র।
প্রাণ হারায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
গণহত্যার প্রথম প্রহরে জহরুল হক হল আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহারারত ইপিআর গার্ডদের হত্যা করা হয়। তারপর হলের কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী ও আব্দুল মজিদকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লাউঞ্জে হত্যা করা হয়। রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় আহমেদ আলী, আব্দুল খালেক, নমি, মোঃ সোলায়মান খান, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ হাফিজুদ্দিন ও মোঃ চুন্নু মিয়াকে।
শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমি আক্রমণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাদলটি শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন শিক্ষকনিবাসগুলোয় এবং মধুসূদন দে'র বাসভবনেও আক্রমণ করে। ১১নং ভবনে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ সাদেককে হত্যা করা হয়। এখানে পাকবাহিনী প্রায় ৫০টির মতো হত্যাকাণ্ড ঘটায়, যাদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ অফিসার (রাজারবাগ পুলিশ লাইনে থেকে পালিয়ে আসা), রাষ্ট্রপতি ভবনের পাহারার দায়িত্বে থাকা ইপিআর সদস্যগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ২৩ নং আবাসিক ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়া নীলক্ষেত বস্তির কয়েকজন অধিবাসী।
মার্চের ২৫ থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে পাকিস্থান সেনাবাহিনী ভিন্ন ধর্মালম্বীদের তিনটি উপাসনালয় ধ্বংস করে ফেলে - কলা ভবন সংলগ্ন গুরুদুয়ারা নানক শাহী, রমনা কালী মন্দির ও শহীদ মিনার সংলগ্ন রমনা শিব মন্দির। রাতে দর্শণ বিভাগের কর্মচারী খগেন দে, তার ছেলে মতিলাল দে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সুশীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, ডাক্কুরাম, ভিমরায়, মণিরাম, জহরলাল রাজবর, মনবরণ রায়, রাজবর ও সংকর কুরীকে হত্যা করা হয়।
এভাবেই নিরস্ত্র, নিরীহ শিক্ষক, ছাত্র ও জনগণকে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে হত্যা করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনমানবশূন্য ভূমি তৈরি করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বাংলার একেকটি মানুষ একেকটি দুর্গ হয়ে বুক চিতিয়ে হানাদারদের কবল থেকে দেশমাতৃকাকে কেবল মুক্তই করল না, মানুষ নামধারী পাকিস্তানি নরাধমদের মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণে বাধ্যও করেছিল।