২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটেছিল?

২৫ মার্চ কালরাত্রির স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন। এর নামফলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন শহীদের নাম রয়েছে।
২৫ মার্চ কালরাত্রির স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন। এর নামফলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন শহীদের নাম রয়েছে।  © সংগৃহীত

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এইদিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরদিনের মতো শেষ করে দিতে মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব পরিকল্পিত নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অপারেশন সার্চলাইটে।

এই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করে পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।

অপারেশন সার্চলাইট কিভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহন করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’

পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তাঁর কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হল আরো ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী দেশজুড়ে বহু নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে। তবে শুরুর গণহত্যার নির্মমতার এক নিরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরের আলো ফোটার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংস অভিযানে ঠিক কতজন মায়ের বুক খালি হয়েছিলো তার সঠিক সংখ্যা আজও জানা যায়নি। ওই দিন রাতে পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হলে ঢুকে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুৃরভাবে হত্যা করা হয়। 

২৬ মার্চ ভোরেই পরিস্থিতি বুঝতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জরিপ করতে বেরিয়েছিলেন মেজর সিদ্দিক সালিম। তাঁর বইয়ে ওই সকালের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলো জরিপ কর ছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা। কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো, অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’।

এই হলো পাকিস্তানি এক সেনা কর্মকর্তার নিজের দেওয়া বিবরণ। মেজর সিদ্দিক সালিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখছিলেন, আগের রাতে চলা একটি বিশেষ সামরিক অভিযান কতটা সফল হয়েছে সেটা সরেজমিনে দেখতে।

‘অপারেশন সার্চলাইট’নামের ওই অভিযান চলেছে ২৫ মার্চ (দিবাগত) মধ্যরাত থেকে ২৬ মার্চ ভোর পর্যন্ত। এই অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মানুষ হত্যা। অভিযানের প্রধান তিনটি লক্ষ্যবস্তুর একটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অপর দুটি লক্ষ্যবস্তু পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদর দপ্তর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযানটি কতটা নৃশংস ছিল, জগন্নাথ হলের ক্যানটিনের কর্মী সুনীল কুমার দাসের বিবরণে তার কিছুটা হলেও আঁচ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘সেদিন (জগন্নাথ হলের) শহীদ মিনারের পাশে কত লোকের যে লাশের সারি ছিল, তার কোনো হিসাব নেই। হল থেকে ছাত্রদের, হলের শিক্ষক-কর্মচারীদের হত্যা করে লাশ এনে কবর দেওয়া হয়। আমিসহ চারজন কর্মচারী একটা ড্রেনে লুকিয়ে ছিলাম। আমরা পরদিন সকালে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই।’

সিদ্দিক সালিকের বই থেকেই জানা যায়, ওই অভিযানে ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগানসহ নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্র-শিক্ষক-কর্মীদের বিরুদ্ধে। মূলত গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তারপর বেশির ভাগ লাশ গণকবর দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক লাশ উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞটি হয়েছে জগন্নাথ হলে। এই গণহত্যার একটি ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নূরুল উলা। তিনি তখন বুয়েটের অধ্যাপকদের জন্য তৈরি চারতলা ভবনে থাকতেন, যেখান থেকে জগন্নাথ হলের ছাত্রাবাস আর মাঠ সরাসরি দেখা যেত।

রশীদ হায়দার সম্পাদিত ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বইটিতে নূরুল উলা লিখেছেন, ‘রাতে দেখি জগন্নাথ হল ছাত্রাবাসের চারপাশ পাকবাহিনীতে ছেয়ে গেছে। হলের কক্ষগুলোতে আগুন। কক্ষগুলোতে ঢুকে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সকালে উঠে দেখি মাঠের পশ্চিম দিকে লাশ এনে জড়ো করা হচ্ছে। আহতদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হচ্ছে। এভাবে কয়েকবার চলল।...আমি তাড়াতাড়ি ক্যামেরা সেট করে একটা কালো কাগজে ফুটো করে ক্যামেরার লেন্সটা জানালার কাচের ওপর রাখলাম। এরপরের তিনটা গণহত্যা ধারণ করলাম। বুলডোজার দিয়ে মাটি খুঁড়তেও দেখলাম।’

জগন্নাথ হলের তৎকালীন দারোয়ান সুনীল চন্দ্র দাসের স্ত্রী বকুল রানী দাস সে সময় কর্মচারীদের টিনশেডের বাসায় ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে হল-সংলগ্ন ইউওটিসির (বর্তমান বিএনসিসি) দেয়াল ভেঙে মিলিটারিদের সাঁজোয়া ট্যাংক হলের ভেতর ঢুকে পড়ে। এরপর শুধুই গুলির শব্দ। একপর্যায়ে এলাকার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয় হানাদারেরা। বাসার পুরুষদের ধরে নিয়ে যায় মাঠের দিকে। সেখানেই তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।’

১৯৭১ সালে বর্তমান মধুর ক্যান্টিনও পাক বাহিনীর রোষানলে পড়ে। এরই সূত্র ধরে '৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মম ভাবে শহীদ হন মধুদা, তার স্ত্রী, বড় ছেলে ও তার নববিবাহিত স্ত্রী। মধুদার স্মরণে মধুর ক্যান্টিন প্রাঙ্গনেই নির্মিত হয় শহীদ মধুদার স্মৃতি ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটির গায়ে লেখা রয়েছে 'আমাদের প্রিয় মধুদা' বাক্যটি।

জানা গেছে, জগন্নাথ হল-সংলগ্ন একটি বাড়িতে থাকতেন মধুর ক্যানটিনের মালিক মধুসূদন দে। তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।  তাঁর ছেলে অরুণ দে বলেন, ‘রাতভর গুলির শব্দ। জগন্নাথ হল থেকে আর্তচিৎকার। সকালে আমাদের বাসায় (সেনা সদস্যরা) এল। আমার দাদা আর নতুন বউদিকে বাসার ভেতরেই গুলি করে মারল। মা অন্তঃসত্ত্বা ছিল। মাকে প্রথমে কিছু করে নাই। বাবাকে গুলি করতে গেলে মা সামনে যায়। তখন বেয়নেট দিয়ে মায়ের হাত কেটে ফেলে। এরপর মাকে গুলি করে। বাবার গায়েও গুলি করে। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় বাবাকে নিয়ে আবার গুলি করে মারল।’

জগন্নাথ হলে সেদিন যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৬৬ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁদের নামের তালিকা উৎকীর্ণ আছে হলের মাঠে গণকবরের জায়গায় তৈরি একটি নামফলকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রতনলাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল বইতে বলা হয়েছে, ওই রাতে সেখানে গণহত্যার শিকার হন চারজন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র এবং ২১ জন কর্মচারী ও অতিথি।

আজও জানা যায়নি সেদিনের গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছিলো কতজন

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও হয়নি। এ নিয়ে বিশদ গবেষণাও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১৯৫ জনের নাম আছে, যাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে আসা অনেককে হত্যা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াইশ থেকে তিনশ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেসের সংলাপেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনশ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে।

১৯৭১ সালের গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন  বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হলেই বাকিরা কাবু হয়ে যাবে। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতেই এখানে হামলা হয়। যেহেতু এটি পরিকল্পিত এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সুসজ্জিত হয়ে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে হত্যা চালিয়েছে, কাজেই এটি গণহত্যা।’

জগন্নাথ হলের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের ইকবাল হলেও (বর্তমান জহরুল হক হল) পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ ছাত্রনেতারা এই হলে থাকতেন বলেই অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিল এই হলটি।

রঙ্গলাল সেনসহ তিনজনের সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বইটিতে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ট্যাংক, জিপে বসানো রাইফেল, মর্টার, ভারী ও হালকা মেশিনগান নিয়ে জহুরুল হক হল আক্রমণ করে চারদিক থেকে। ছাত্রনেতা ও কর্মীরা হল ছেড়ে চলে গেলেও সাধারণ ছাত্র ও কর্মচারীরা হলে ছিল। জহুরুল হক হল আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহারারত ইপিআর সৈনিকদের হত্যা করা হয়। এরপর ওই ভবনের ওপর সামনে ট্যাংক ও ওপরে কামান বসিয়ে জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে গুলি করা হয়।

জহুরুল হক হলের মূল ভবনের সিঁড়িতে নিহত ছাত্র যাঁদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাঁদের নয়জনের একটি তালিকা আছে। জহুরুল হলসংলগ্ন নীলক্ষেত আবাসিক এলাকায় তিনটি বাড়ির ছাদে আজিমপুর থেকে পালিয়ে আসা ইপিআর সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেও গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ২৩ নম্বর ছাদ থেকেই শুধু ৩০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খুব কাছেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। ২৭ মার্চ সকালে শহর থেকে কারফিউ তুলে নেওয়ার পর সায়মন বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফরাসি আলোকচিত্রী মিশেল লরা। ২৫ মার্চ রাতের ধ্বংসযজ্ঞ তাঁরা প্রত্যক্ষ করেন শহরজুড়ে। ২০১২ সালের ২৩ মার্চ ঢাকায় প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে সায়মন ড্রিং বলেন, ২৭ মার্চ ঘুরতে ঘুরতে তিনি ইকবাল হলেও ঢুকেছিলেন। তিনি সেখানে নিজে ৩০টি লাশ গুনে দেখেছেন। ড্রিং জানান, সেদিন মর্টারের শেল আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিতে শুধু ইকবাল হলেই নিহত হয়েছিলেন ২০০ নিরপরাধ ছাত্র। হামলার দুই দিন পরও দেখা যাচ্ছিল পুড়ে যাওয়া রুমের মধ্যে পড়ে থাকা লাশ আর লাশ। পাকিস্তানি বাহিনী আরও বহু লাশ সরিয়ে ফেলেছিল আগেই।

বাদ পড়েনি রোকেয়া হলও

২৫ মার্চ রাতে মেয়েদের আবাসিক হল রোকেয়া হলেও আক্রমণ হয়েছিল। কারণ, এই হলের মেয়েরা ডামি রাইফেল হাতে কুচকাওয়াজ করতেন। অবশ্য ওই হলের বেশির ভাগ মেয়ে আগেই হল ছেড়ে গিয়েছিলেন। অল্প কয়েকজন মেয়ে ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রোকেয়া হলে কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে ঢাকার সে সময়ের মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি প্রতিবেদন পাঠান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের একটি কক্ষে ছয়টি মেয়ের লাশ পা-বাঁধা ও নগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় হলের কর্মচারী আহমেদ আলী, আবদুল খালেক, নমি, মো. সোলায়মান খান, মো. নুরুল ইসলাম, মো. হাফিজুদ্দিন ও মো. চুন্নু মিয়াকে।

নির্মমতা থেকে বাদ পড়েননি কর্মচারীরাও

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানকার চার কর্মচারী, সলিমুল্লাহ হলে ঢুকে সেখানকার ১২ জন ছাত্র, ফজলুল হক হলের সাতজন, সূর্য সেন হলের সাতজন এবং মুহসীন হলের ১০ জন ছাত্রকে হত্যা করে। এর বাইরে ২৬ মার্চ সকালে গুরুদুয়ারা নানক শাহী, শিব ও কালীমন্দিরে ঢুকে সেখানকার পুরোহিতদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৭ মার্চ রমনা কালীমন্দিরে ২৭ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।

তবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোন মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।


সর্বশেষ সংবাদ