বগুড়ায় কাল্পনিক ভূতের গ্রাম
ভূত শব্দের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। ছোটবেলার কোন রূপকথা থেকেই হোক আর নিজের মনের অজান্তেই কোন কাল্পনিক ছবি থেকেই হোক ভূত বলতে কোন অশরীরী সাদা কিংবা কালো কাপড় ধারণ করা লাল রংয়ের চোখ বিশিষ্ট কিছু একটা বোঝায় হয়তো। এই ভূতের সাথে যদি কারো কখনো সরাসরি সাক্ষাৎ হয় তাহলে তো আলাদা করে বর্ণনা দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের এই যুগে ভূতের কোন অস্তিত্ব নেই বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। ভূত নামক এই বিশেষ্যটি কেবল কাল্পনিক ও নিছক অবাস্তব।
কিন্তু যদি কখনো শোনেন ভূতের ভয়ে একটি গ্রাম অনত্র গিয়ে বসবাস শুরু করেছে তাহলে কি অবাক হবেন? অবাক হওয়ারই কথা! অবাক না হলেও হয়তো নড়ে চড়ে বসবেন। ঘটনার সতত্য মিলে গেছে বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে গোহাইল উপজেলার পিচুলগাড়ী গ্রামে। এই গ্রামে ১৯৮০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন লোক বাস করেনা।
চারদিকে রাস্তাবিহীন দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন একটি গ্রাম পিচুলগাড়ী। গ্রামটিকে স্থানীয়ভাবে ভূতের গ্রাম বলেও আখ্যা দেয় অনেকেই। অন্যান্য গ্রাম থেকে এই গ্রামে পৌঁছাতে প্রায় সময় লাগে প্রায় মিনিট বিশেক। মূল গ্রামের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বিঘা জমি জুড়ে শুধু ঘন জঙ্গল। প্রবেশের পরে এই জঙ্গলের মাঝে দেখা গেল একটি হাঁসের খামার, মসজিদ, শুকনো পুকুর ও কবর।
দেখা পাওয়া গেল পিচুলগাড়ী গ্রাম সংলগ্ন তাড়ইল গ্রামের হাদিসুর রহমানের (২৫) সাথে। তিনি জানালেন ‘‘১৯৮০ সালের দিকে নান্নু হাজি নামের গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক ব্যক্তি ডাকাতের হাতে খুন হলে ওই পরিবারের সদস্যরা ভীত হয়ে পরে। সে সময় এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় রাত নামলেই চোর-ডাকাতের উপদ্রব বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন: মেডিকেলে ভর্তি আবেদন শুরু ২৮ ফেব্রুয়ারি
রাস্তাঘাট ঠিক-ঠাক না থাকার কারণে গ্রামটি চোর-ডাকাতের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। তখনো গ্রামে বসবাসরত ৪০-৫০ টি পরিবারের বসত বাড়ি, বড় একটি দীঘি ও মসজিদ ছিল। এদিকে নান্নু হাজির পরিবার গ্রাম ছেড়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়া শুরু করলে অন্যান্য বাসিন্দারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তারাও পাশের গ্রামে চলে যেতে শুরু করলে গ্রামটি জনমানব শূণ্য হতে থাকে। পরে লোকমুখে এই গ্রামের নাম হয়ে যায় ভূতের গ্রাম”।
এভাবে বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও গ্রামবাসী তাদের জমি-জমা ও গ্রামের প্রতি মায়া ছাড়তে পারেনি। তারা এখনো তাদের জমিতে ধান, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষাবাদ করে যাচ্ছে। কেউ মারা গেলে পরিত্যক্ত সেই গ্রামেই কবর দেয়া হয়। প্রাচীন আমলে স্থাপিত মসজিদে আজো মুসল্লিরা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন।
তবে ভূতের বিষয় নানা কল্পনা ও প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায়না। নিরবিচ্ছিন্ন, রূপকথার মতো কাল্পনিক দাঁড়িয়ে থাকা এই গ্রামে অনুসন্ধান করে গ্রামের প্রবীণ মানুষদের কাছে থেকে জানা গেল মসজিদের দক্ষিণ পূর্বদিকের একটি বটগাছ ও জাম গাছকে বলা হয় ভূতের গাছ। জাম গাছের ফল খেলে ও বট গাছের ডাল ভাঙ্গলে সুস্থ্য মানুষ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার লোক মুখে প্রচলিত সে ভৌতিক গল্প। প্রচলিত কথার উপরে ভিত্তি করে আজো কেউ কখনো গাছের ফল খাওয়া ও ডাল ভাঙ্গার দুঃসাহস দেখায়নি।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রে গেলেই মিলবে টিকা, লাগবে না নিবন্ধন
নান্নু হাজির মৃত্যুর পর ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলে পরিত্যক্ত এই গ্রামটি এখন পুরোপুরি ভূতুড়ে গ্রামে পরিণত হয়েছে। তবে আশ্চর্য কথা এই যে ভূতের বিষয়ে কেউ স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি। আর ভূতুরে গ্রামের বিষয়ে বললে বলা বাহুল্য জনমানবশূণ্য এমন যায়গায় দৃশ্যপটের বাহিরে অন্য কিছু থাকা কি স্বাভাবিক নয়? যদি এমন কিছু নাই বা থাকে তাহলে লোক মুখে ছড়িয়ে পরা ভূতের গ্রাম নামটা কি শুধুই নিছক কাল্পনিক গল্প? এই গল্পের জট খোলা মুশকিল।
গ্রাম বিষয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলী আতোয়ার তালুকদার ফজু ও কয়েকজন ইউপি সদস্য বলেন, বর্তমানে এই গ্রামে আইন শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তার কোন সমস্যা নেই। যারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে তারা চাইলে আবারো ফিরে আসতে পারে। তবে রাস্তাঘাট ও বিদ্যুৎ সংযোগের সুবিধা পেতে চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সরকারি অনুদান পেলেই আবারো গ্রামের লোক তাদের পুরানো ভিটা-মাটিতে ফিরবে এটাই প্রত্যাশা করি।