মধুকবির বিদায় ঘাট— ‘যেখানে শেষ বিদায় হয়নি মা-ছেলের’

এই সেই বিদায় ঘাট
এই সেই বিদায় ঘাট

স্মৃতিঘেরা জোয়ার-ভাটার সেই কপোতাক্ষ নদ এখন মৃতপ্রায়। কচুরিপানা কপোতের চোখের মতো স্বচ্ছ জলরাশি ঢেকে রেখেছে। তার মধ্যে এক মধুপ্রেমী মাঝি পাল উড়িয়ে নৌকা ভাসিয়েছেন। ছোট নৌকা। পর্যটকরা ২০ টাকার বিনিময়ে নৌকায় চেপে কপোতাক্ষের পানিতে হাত দিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে নিচ্ছেন। পানির অন্তরে বাংলা সনেটের জনক মধুকবির প্রতিচ্ছবি খুঁজে ফিরছেন যেন।

যশোরের কেশবপুর উপজেলা সদর থেকে সাতক্ষীরা সড়ক ধরে এক কিলোমিটার এগোলে রাস্তার ডানে ধবধবে সাদা মধু তোরণ। এখান থেকেই মধু সড়ক শুরু। পিচঢালা পথ। বাঁকের পর বাঁক। আমবাগান, কুলবাগান, হলুদ ও সরিষা ক্ষেত পেরিয়ে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি পৌঁছাই কপোতাক্ষ, মধুকবি আর মধুমেলার টানে।

সাগরদাঁড়ির দত্তবাড়িতে মধুকবি ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। দত্তবাড়ির বিরাট পুকুর, আমবাগান, অট্টালিকা সব বিলীন হয়ে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দত্তবাড়ির কয়েকটি কক্ষ সংস্কার করে গড়ে তুলেছে মধুসূদন জাদুঘর। নিচতলার ছয়টি কক্ষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দত্ত পরিবারের লোহার বাক্স, টিফিন ক্যারিয়ার, খাট, চেয়ার-টেবিল। এসব দেখে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দক্ষিণে এগোলে একটি তুলসীগাছ। গাছে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, এটিই কবির আঁতুড়ঘর। বাইরে এসে দত্তবাড়ির মন্দিরের সিঁড়িতে বসি। বাড়ির সামনে শিল্পী বিমানেশচন্দ্র বিশ্বাসের হাতে নির্মিত মধুসূদনের আবক্ষ ভাস্কর্য। অনেকেই মধুকবির আবক্ষ ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন।

হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে যাই। রাস্তার বাম পাশে মধুসূদন একাডেমি। স্থানীয় যুবকদের ঐকান্তিক চেষ্টায় গড়ে তোলা মধুসূদন একাডেমিকে সমৃদ্ধ করেছে কবির দলিল-দস্তাবেজ, ছবি, কবিতা। দেয়ালজুড়ে কবির ঐতিহাসিক নানা রকম মূল্যবান প্রামাণ্যচিত্র। এসব দেখে ঐতিহাসিক কপোতাক্ষের দিকে এগিয়ে যাই। একদিকে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, অন্যদিকে কাঠবাদাম তলা। প্রবীণ কাঠবাদাম গাছটি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কথিত আছে এই কাঠবাদাম তলায় বসে কবি কবিতা লিখেছেন। ডাকবাংলোর প্রাচীর শেষেই বিখ্যাত কপোতাক্ষ। নদের যৌবন শেষ। তবুও কপোতাক্ষ তো! এখানে পালতোলা রঙিন নৌকায় নৌবিহারের সুযোগ রয়েছে। নদের কিনার দিয়ে হেঁটে সামনে এগোলে ‘বিদায় ঘাট’। বিদায় ঘাটে একটি শ্বেতপাথরে উত্কীর্ণ আছে ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি। বিদায় ঘাট নিয়েও গল্পের যেন শেষ নেই, কবি ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান স্ত্রী হেনরিয়েটাকে নিয়ে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত সাগরদাঁড়ির মাটি স্পর্শ করতে দেননি। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে কয়েক দিন বজরায় ভেসে কবি কলকাতা ফিরে যান। এর পর থেকে ওই স্থানের নাম ‘বিদায় ঘাট’।

কবির স্মৃতি বিজড়িত কাঠ বাদাম গাছ ছবি : ফিরোজ গাজী

 

মধুমেলা: মধুসূদনের জন্মদিন ঘিরে অনুষ্ঠিত মধুমেলায় এই বিদায় ঘাট, দত্তবাড়ির আঙিনা, কাঠবাদাম তলা জমজমাট হয়ে ওঠে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মধুভক্ত সাগরদাঁড়ির মাটিতে পা রেখে শুধু সনেটের জাদুকর মধুসূদনকেই খুঁজতে থাকেন। মেলা শুরু হয়েছিল ১৮৯০ সালে। এ সময় থেকেই সাগরদাঁড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মধুসূদন স্মরণ উত্সব। মধুমেলা আর স্মরণ উত্সবে সাগরদাঁড়ি জেগে ওঠে। জেগে উঠে কবির লাখ লাখ ভক্ত। মধুসূদনের ভাইয়ের মেয়ে মানকুমারী বসু। তিনিও কবি। তিনি ১৮৯০ সালে কাকার স্মৃতি ধরে রাখতে সাগরদাঁড়িতে গ্রাম্য মেলার আয়োজন করেন। সেই মেলাই আজকের মধুমেলা। আগে প্রতিবছর মাঘ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ তিন দিনের মেলা অনুষ্ঠিত হতো। এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ জানুয়ারি কবির জন্মদিনকে ঘিরেই সাত দিনের মধুমেলা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে মধু জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সরকার এক মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ১৯৮৪ সালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় মধুমেলার দায়িত্ব নেওয়ার পর এর কলেবর বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় প্রশাসন ও বিসিক মধুমেলাকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মধুমেলায় অংশ নেওয়ার জন্য সাগরদাঁড়িতে এসেছেন। মেলায় সমগ্র বাংলাদেশ থেকেই মধুকবির ভক্তরা ছুটে আসেন। দা, খন্তা, ঝুড়ি, কোদাল, কুলা, মাছ ধরার দুড়ে, চারো ডালাসহ মেলায় বিক্রি হয় হাতে তৈরি দেশি চানাচুর, দানাদার, লেডিকিনি, গরম জিলাপি ইত্যাদি।

কিভাবে যাবেন: ঢাকার গাবতলী থেকে সাতক্ষীরাগামী পরিবহনে ৫০০ টাকায় সরাসরি কেশবপুর। সেখান থেকে প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, ভ্যান বা নছিমনে সোজা দত্তবাড়ি সাগরদাঁড়ি। অথবা যেকোনো পরিবহনে যশোর। সেখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কেশবপুর। যশোর থেকে বাসে কেশবপুর আসা যায়। তারপর ভ্যান বা নছিমনে সাগরদাঁড়ি। (সূত্র: কালেরকণ্ঠ)


সর্বশেষ সংবাদ