যেভাবে দান করলে সওয়াব বেশি

দান
দান  © প্রতিকী ছবি

কোরআন-সুন্নায় আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ ব্যয় করার বহু নির্দেশ এসেছে। দানের প্রতি ঈমানদারকে আল্লাহ তাআলা এভাবে নির্দেশ দিয়েছেন- 'তোমরা যারা ঈমান এনেছো; তারা তার রাস্তায় ধন-সম্পদ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাক। 

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ বাস করে, যারা অভাব থাকা সত্ত্বেও কারো কাছে মুখ ফুটে কিছু চায় না। অভাবের তাড়নায় বহু প্রয়োজনকে বিসর্জন দিয়েও নিজের আত্মসম্মান বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে। পবিত্র কোরআনে এ ধরনের লোকদের সাহায্য করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ আল্লাহ তাআলার রাস্তায় ব্যয় করার সওয়াব অনেক বেশি। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত খুরাইম ইবনু ফাতিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার রাস্তায় কিছু ব্যয় করে (এর বিনিময়ে) তার জন্য সাতশত গুণ সওয়াব লেখা হয়। (তিরমিজি, মিশকাত, তারগিব)

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘দান-খয়রাত ওই সব লোকের জন্য, যারা আল্লাহর কাছে আবদ্ধ হয়ে গেছে, জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়। তাদের সাবলীল চলাচলের জন্য অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবহীন মনে করে। তুমি তাদের তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা লোকদের কাছে নাছোড় হয়ে ভিক্ষা করে না। এবং তোমরা বৈধ সম্পদ থেকে যা ব্যয় কর সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যকরূপে অবগত। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৩)

আরও পড়ুন: সহযোগী অধ্যাপক নেবে মেরিটাইম ইনিভার্সিটি।

হজরত আদি ইবনু হাতিম তাঈ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করেন, কোন ধরনের দান-খয়রাত বেশি উত্তম?

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, 'আল্লাহ তাআলার রাস্তায় সেবার উদ্দেশ্যে গোলাম দান করা; অথবা ছায়ার ব্যবস্থা করার জন্য তাবু দান করা কিংবা আল্লাহর রাস্তায় জওয়ান উষ্ট্রী দান করা।' (তিরমিজি, তালিকুর রাগিব)

হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'উত্তম সাদকা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার রাস্তায় ছায়া সৃষ্টির জন্যে তাবু দান করা; আল্লাহ তাআলার রাস্তায় সেবার উদ্দেশ্যে গোলাম দান করা অথবা আল্লাহ তাআলার রাস্তায় জাওয়ান উষ্ট্রী দান করা।'

আবার আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা মধ্যবিত্তের সমাজে বাস করছে, তাদের দেখে সবাই মোটামুটি সচ্ছল মনে করে। কিন্তু বাস্তবে তারা অভাব-অনটনে জর্জরিত। কিন্তু তারা তা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। এ ধরনের লোকদের সদকা করাও সবচেয়ে উত্তম সদকা।

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ায় এবং দু-এক গ্রাস খাবার বা দু-একটা খেজুর ভিক্ষা নিয়ে ফিরে যায় তারা (প্রকৃত) মিসকিন নয়। এ কথা শুনে সাহাবীরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, তাহলে মিসকিন কে? (উত্তরে) তিনি (সা.) বলেন, মানবীয় মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মতো সামর্থ্য যার নেই আর সমাজের মানুষও তাকে অভাবী বলে জানে না, যাতে তাকে দান করতে পারে এবং সে নিজেও (মুখ খুলে) কারো কাছে কিছু চায় না। ’ (এ ব্যক্তি হলো প্রকৃত মিসকিন অর্থাৎ আর্থিক অনটনভুক্ত গরিব ভদ্রলোক)। (মুসলিম, হাদিস : ২২৮৩)

হাদিস দুটিতে উল্লেখিত দানের বিষয়গুলো সাধারণভাবে সব মানুষের উপকারের সঙ্গে জড়িত। তাই যে কাজ মানুষের বেশি উপকারে। সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হয়; সেসব কাজে দান করাই সবচেয়ে বেশি সওয়াবের কাজ। আর সঠিক পদ্ধতিতে আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা করার ফজিলত অপরিসীম। যারা আল্লাহর নির্দেশনা মেনে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে, মহান আল্লাহ তাদের দানের প্রতিদান তাদের বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন।

জেনে নিন যেসব দান করলে সওয়াব বেশি হয়-

১। আল্লাহর রাস্তায় দান যেমনই হোক; মহান আল্লাহ ওই দানকে লালন করেন। যা এক সময় দানকারীর জন্য পাহাড়া সমতুল্য হয়ে যায়। হাদিসে পাকে বিষয়টি এভাবে ওঠে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সদকা করে; আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত অন্যকিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তাআলা তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তা লালন করেন; যেমন তোমাদের কেউ তার ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন করে। এমনকি একসময় সে (সামান্য খেজুর পরিমাণ) সদকা পাহাড়তুল্য হয়ে যায়।’(বুখারি ও মুসলিম)

সুতরাং সাদকা দিতে হবে আপন-স্বজন, অসহায় বা অন্যদেরকেও। হাদিসে অন্যদের চেয়ে আপনজনকে সাদকায় সাওয়াব দ্বিগুণ রয়েছে বলেছেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘নিশ্চয়ই মিসকিনকে সদকাদান একটি সদকা, আর আত্মীয়কে দানে রয়েছে দুটি সদকা ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা।

২। গোপনে দান করা: পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সাদকা করো তবেভালো কথা। আর যদি তা গোপনে গরিব-দুঃখীকে পৌঁছে দাও তবে তা তোমাদের জন্য অতি উত্তম এবং এভাবে তোমাদের অনেক গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর তোমরা যা কিছু করে থাকো আল্লাহ অবশ্যই তা জানেন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দান-সদকা করল, অতঃপর তা গোপন করল, এমনকি তার বাম হাত জানল না তার ডান হাত কী দান করছে- ওই ব্যক্তি হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহর সুশীতল ছায়া প্রাপ্ত হবেন। যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবেনা। (বুখারি ও মুসলিম)

আরও পড়ন: ইবিতে ছাত্রী হেনস্তা: প্রভোস্টের আশ্বাসে ছাত্রীদের আন্দোলন স্থগিত।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নফল সদকা গোপনে দান করলে তাতে ৭০ বেশি সাওয়াবলাভ হয়, পক্ষান্তরে ফরজ সদকা তথা জাকাত প্রকাশ্যে আদায় করলে তাতে ২৫ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দানের মাধ্যমে সাওয়াবলাভের পাশাপাশি গোনাহ মাফের ঘোষণাও দিয়েছেন।

৩। হালাল রুজি থেকে দান করা: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও তাঁর রাসুল প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) সদকার জন্য সম্পদের হালাল ও ভালো অংশ বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদে লোক দেখানো দান-সাদকায় কোনো সওয়াব নেই বলেও হুঁশিয়ার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- তোমরা কখনো ছাওয়াব অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না ব্যয় করবে তা থেকে, যা তোমরা ভালবাসো। (সুরা আলে ইমরান : ৯২)

৪। দান গ্রহীতাকে খোঁটা ও কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা : ইসলামে সাদকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনদের প্রাধান্যের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যেসব আত্মীয়স্বজনের ব্যয়ভার বহন করতে হয় না, এ ধরনের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যারা অভাবি, তাদের সদকা দেওয়া একজন মুসলমানের জন্য মুস্তাহাব। 

পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায় সদকা গ্রহীতাকে খোঁটা ও কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুরাটির ২৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদকা বাতিল করো না।

৫। যাদের প্রয়োজন তাদের অগ্রাধিকার দেয়া: রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, সে ব্যক্তি আমার প্রতি (যথাযথভাবে) বিশ্বাস স্থাপন করেনি, যে পরিতৃপ্ত হয়ে ঘুমায় এবং তার প্রতিবেশী তার পাশে ক্ষুধার্ত থাকে অথচ সে তার সম্পর্কে জানে।’ (মুজামুল কাবির, হাদিস : ৭৫১) এদিকে, গোপন দান প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলামে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে প্রকাশ্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

দুর্ভিক্ষের দিনে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণির ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি। তুমি কি জানো বন্ধুর গিরিপথ কী তা হলো দাস মুক্ত করা অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাবার দান করো এতিম আত্মীয়কে অথবা দারিদ্র্য নিষ্পেষিত নিঃস্বকে। (সুরা বালাদ, আয়াত : ১১-১৬)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, যথাসাধ্য আল্লাহর রাস্তায় সাদকা করা। যেখনে যেভাবে দান করা প্রয়োজন; হক আদায় করে দান-সাদকা করা। দান-সাদকার ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহর সুন্দর ও উত্তম উপদেশগুলো মেনে চলা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে দান-সাদকা করার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নায় ঘোষিত দান-সাদকার ফজিলত ও সওয়াব পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।


সর্বশেষ সংবাদ