বিএনপি-জামায়াত সমর্থক ঢাবি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলে ভাঙনের সুর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলে ভাঙনের সুর উঠেছে। সংগঠনটিতে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেফিরে কয়েকজন শিক্ষকের হাতে নেতৃত্ব থাকা, বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের বড় একটি অংশকে কোণঠাসা করে রাখা, জামায়াতপন্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া এবং আওয়ামী লীগ আমলে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিতর্কিত ইস্যুগুলোয় প্রতিবাদ না করে চুপ থাকাসহ নানা কারণই এই ভাগ হওয়ার প্রাথমিক কারণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সাদা দলে নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে সাদা দলের বড় একটি অংশ ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। আর এ কারণেই দলটি থেকে জাতীয়তাবাদী আদর্শের অন্তত শতাধিক শিক্ষক আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; যে সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি ভাগ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের। শুধু ভাগ নয়, শিক্ষক সমিতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্বাচনে আলাদা প্যানেল দেওয়ার কথাও ভাবছেন তারা।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে দুটি ধারা বিরাজ করেছিল। এর একটি হচ্ছে আওয়ামীলীগ পন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল এবং অপরটি আওয়ামী বিরোধী। পরবর্তীতে ৯০-এর দশকে এসে আওয়ামী বিরোধী শিক্ষক গ্রুপটি বিএনপি-জামায়াতপন্থী (সাদা) ও বামপন্থী (গোলাপি) দলে ভাগ হয়। তবে বিগত দিনগুলোতে তাদের (গোলাপি) কার্যক্রম তেমন একটা দেখা যায়নি। এর ফলে ঢাবি শিক্ষক রাজনীতি বলতে আওয়ামীলীগ পন্থী (নীল দল) এবং বিএনপি-জামায়াতপন্থী (সাদা দল) এই দুটি সংগঠনকে বুঝাতো।
জানা গেছে, ভাগ হতে যাওয়া ওই অংশটির নেতৃত্বে রয়েছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাদা দলের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম তালুকদার, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী এবং তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মেজবাহ-উল-ইসলাম।
আরও পড়ুন: ‘নীল দল ১০০০, সাদা দল ১০০’— ঢাবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জিতবে কারা?
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম তালুকদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন নেতৃত্ব, অর্থাৎ দলকে একটা নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের কবল থেকে রক্ষা করা। ক্যাম্পাসে সাদা দল সর্বদা দেশের গণতন্ত্র ও শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সোচ্চার থাকবে। কখনোই কোনো ফ্যাসিস্ট বা তাঁবেদারি প্রশাসনের সহায়ক হবে না। আর এ জন্য সাদা দলের বর্তমানের সিন্ডিকেটের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এখানে আমাদেরকেই আসতে হবে তা নয়, যেকোনো নতুন নেতৃত্ব আসলেই দল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কল্যাণকর হবে।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রথমবারের মতো সাদা দলের এই শিক্ষক সংগঠনটি ভেঙে যাচ্ছে। যদিও বর্তমান নেতৃত্বে থাকা দলটির শিক্ষকরা বলছেন, সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনেই তারা সবকিছু পরিচালনা করছেন। এখানে কোনো সংকট নেই। বিএনপি ক্ষমতায় না থাকাকালীন সময়েও সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে সব করা হয়েছে বলে দাবি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে দুটি ধারা বিরাজ করেছিল। এর একটি হচ্ছে আওয়ামীলীগ পন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল এবং অপরটি আওয়ামী বিরোধী। পরবর্তীতে ৯০-এর দশকে এসে আওয়ামী বিরোধী শিক্ষক গ্রুপটি বিএনপি-জামায়াতপন্থী (সাদা) ও বামপন্থী (গোলাপি) দলে ভাগ হয়। তবে বিগত দিনগুলোতে তাদের (গোলাপি) কার্যক্রম তেমন একটা দেখা যায়নি। এর ফলে ঢাবি শিক্ষক রাজনীতি বলতে আওয়ামীলীগ পন্থী (নীল দল) এবং বিএনপি-জামায়াতপন্থী (সাদা দল) এই দুটি সংগঠনকে বুঝাতো।
“যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে বা যারা করছেন—বিগত সংকটকালে তাদের ভূমিকাগুলো দেখা দরকার। আমরা সবকিছু সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনেই পরিচালনা করছি। এখানে কোনো সংকট নেই। আমাদের সবকিছু নিয়ম মেনে এবং সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে করা হচ্ছে—অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান
আলাদা হতে যাওয়া সাদা দলের অন্তত তিন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলে তারা অভিযোগ করেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকার যখন জাতীয়বাদী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছিল এবং বিদেশি শক্তির মদদে একটি বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি চাপিয়ে দিয়েছিল; তখন রহস্যজনকভাবে সাদা দলের বর্তমান নেতৃত্ব কোনো ভূমিকা পালন করেনি। আমরা মনে করি, তারা সামগ্রিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।’ এ সময়ে গত কয়েক বছর ধরে বামপন্থী শিক্ষকদের নিয়ে একটি নতুন প্ল্যাটফর্মও (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক) তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন: ঢাবি শিক্ষক সমিতি নির্বাচনের প্রস্তুতি নেই, ডিসেম্বরে হচ্ছে না ভোট
ওই শিক্ষকদের আরও অভিযোগ, গত ১৬ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সাদা দলের বেশির ভাগ শিক্ষক একটি আন্দোলনের তাগিদ দিলেও বর্তমান নেতৃত্ব তাতে কর্ণপাত করেননি। সাদা দলের এই বিভক্তি বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি দীর্ঘদিনের অনাস্থা ও অবিশ্বাস ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে যোগদান করলে কেউ কেউ নিজেকে বিচ্ছিন্নভাবে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, আবার কখনও যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দাবি করেন। যদিও এই ধরনের কোনো দায়িত্ব দলের সাধারণ সভার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
জানা গেছে, সাদা দলের সর্বশেষ কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক লুৎফর রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম, কোষাধ্যক্ষ হিসেবে রয়েছেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার এবং প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে বর্তমান প্রক্টর এবং শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ। এই কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর।
“আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন নেতৃত্ব, অর্থাৎ দলকে একটা নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের কবল থেকে রক্ষা করা। ক্যাম্পাসে সাদা দল সর্বদা দেশের গণতন্ত্র ও শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সোচ্চার থাকবে। কখনোই কোনো ফ্যাসিস্ট বা তাঁবেদারি প্রশাসনের সহায়ক হবে না। আর এ জন্য সাদা দলের বর্তমানের সিন্ডিকেটের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এখানে আমাদেরকেই আসতে হবে তা নয়, যেকোনো নতুন নেতৃত্ব আসলেই দল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কল্যাণকর হবে— অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম তালুকদার
আলাদা হতে যাওয়া সাদা দলের শিক্ষকদের অভিযোগ, ইতোমধ্যে সাদা দলের আসন্ন কেন্দ্রীয় কমিটিতে আবারও অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম ও অধ্যাপক ড. কালাম সরকারকে রাখা হচ্ছে, যারা বিগত ১০-১৫ বছর ধরে কমিটিতে রয়েছেন। ঘুরেফিরে এই কয়েক শিক্ষকের মধ্যে থেকে আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক, অনুষদ আহ্বায়ক বা কমিটির বিভিন্ন পদে আসার বিষয়টিও দল ভাগ হওয়ার অন্যতম কারণ বলে অভিযোগ তাদের।
এসব বিষয়ে সাদা দলের সদ্য সাবেক আহ্বায়ক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে বা যারা করছেন—বিগত সংকটকালে তাদের ভূমিকাগুলো দেখা দরকার। আমরা সবকিছু সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনেই পরিচালনা করছি। এখানে কোনো সংকট নেই। আমাদের সবকিছু নিয়ম মেনে এবং সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে করা হচ্ছে।
বর্তমানে সাদা দলে কোনো সংকট নেই জানিয়ে সাদা দলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান জানান, এখানে কোনো সংকট আছে বলে আমরা মনে করি না। এ সময়ে অভিযোগকারীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই অধ্যাপক। পাশাপাশি তাদের প্রোফাইলগুলো ভালোভাবে দেখা দরকার বলে মনে কনে তিনি। অধ্যাপক ড. ছিদ্দিক আরও বলেন, ‘তারা পদ বা দায়িত্ব পাওয়ার জন্য কতটা উপযোগী—তা তাদের নিজেদের বিচার করে দেখা উচিত। এখানে সাদা দল জামায়াত বা বিএনপিপন্থী না, সাদা দল সবসময়ই সাদা দল বলে দাবি করেন তিনি।