নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের খোলা চিঠি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক  © লোগো

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। আজ শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) দেশবাসীর উদ্দেশে সংগঠনটির দেয়া খোলা চিঠিতে তারা এ কথা জানায়।

এতে বলা হয়েছে, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সব নাগরিকের মতো আমরাও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য উপাদান হলো অবাধ-অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। একটি জনগ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেকোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৈধতার প্রধানতম উৎস। এ কারণে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় সার্বিক শাসন ব্যবস্থা একটা বৈধতার সংকটে পড়েছে। আর বৈধতার এ সংকট কাটাতে, ক্ষমতায় থাকার জন্য পশ্চিমা পরাশক্তি আর আঞ্চলিক শক্তির কাছ থেকে সম্মতি নেওয়াটাই গত এক দশকে ক্ষমতাসীনদের মূল কাজে পরিণত হয়েছে।

আমাদের দেশের নির্বাচনকে ঘিরে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব, অন্যদিকে রাশিয়া, চীন ও ভারত তাদের নিজ নিজ স্বার্থ বিবেচনায় বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে এবং কখনো কখনো মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও লিপ্ত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি ও শান্তির কিছু নির্দেশ করে না। শুধু আইনি বা সাংবিধানিক নিয়মরক্ষার যুক্তি দিয়ে যেনতেনভাবে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষ কথা নয়, গ্রহণযোগ্য ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সঙ্গে শাসনব্যবস্থার  বৈধতা, গণতন্ত্র, শাসকদের জবাবদিহি ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত—এ সবকিছুই জড়িত।

তাই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের বিবেচনায় এটা বলাই যেতে পারে যে, সারাদেশ আজ এক প্রকট রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে, যা প্রকারান্তরে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অস্তিত্বের প্রশ্নটিকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় যাক না কেন, জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি থাকে না, দায়বদ্ধতা থাকে না। এরকম শাসনব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অযৌক্তিক ও আকস্মিক বৃদ্ধিতেও সরকার তো তার দায় স্বীকার করেই না, উল্টো জনমানুষের দুর্ভোগ নিয়ে নিয়মিত মিথ্যাচার অথবা উপহাস করতেও পিছপা হয় না। এতে দুর্নীতিগ্রস্ত আর অসৎ মানুষদের আইনের আওতায় আনা যায় না। তারাই সাধারণত সরকারি দলের ছায়াতলে থেকে শত অপরাধ করেও আরামে-আয়েশে নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করে।

আবার তাদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে বেশি প্রভাবশালী অংশ, দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ শোধ করে না এবং দেশের মানুষের অর্থ বাধাহীনভাবে বিদেশে পাচার করতে থাকে। ফলে সৎ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবন-যাপন হয়ে উঠছে দুরূহ ও দুঃসহ এবং সার্বিকভাবে সাধারণ জনগণের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা খর্ব হতেই থাকে; সর্বজনের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা সরকারি নীতিতে প্রতিফলিত হতে পারে না।

গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে, প্রশ্নবিদ্ধ আগের দুই নির্বাচন এদেশে বস্তুত একটা একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েমের পথ সুগম করেছে। এই সময়কালে এ দেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকারগুলো, বিশেষ করে মতপ্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মৌলিক মানবাধিকার নির্মমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা করার মতো গুরুতর অপরাধকেও স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে। এতে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। একইসঙ্গে সম্পদের অসম বণ্টন, পক্ষপাতিত্বমূলক বিচারপ্রক্রিয়া এবং সরকারি দল ও প্রশাসনের দমনপীড়ন দেশকে এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছে।

আমরা আশা করেছিলাম, এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সর্বজনের সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অবাধ, প্রতিযোগিতাময় ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের প্রচেষ্টা সবার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার নবায়ন ব্যতীত আর কিছুই জনগণকে দিতে পারবে না।

একটি শক্তিশালী বিরোধীদলের উপস্থিতি সংসদীয় শাসন পদ্ধতির অন্যতম পূর্বশর্ত হওয়া সত্ত্বেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আগের মতো একটা 'পুতুল' বিরোধী দলও গড়ে তোলা মুশকিল হয়ে যাবে। কারণ, অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ অনুপস্থিত বলে বিএনপিসহ ৬৩টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। সরকারি দলের সঙ্গে বা সরকারি দলের সমর্থন নিয়ে যে দলগুলো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সেগুলো নামেমাত্র ভুঁইফোড় রাজনৈতিক সংগঠন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এসব সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবেই রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে।

মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলো সাক্ষী, আসনগুলো নির্বাচনের আগেই ভাগাভাগি হয়ে গেছে! জাতীয় পার্টি ভাগ পেয়েছিল ২৬টি আসন আর সংসদে 'বিরোধী দল' হওয়ার আশ্বাস। কিন্তু ইতোমধ্যে তাদের ২৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে—দমনপীড়নের অভিযোগ তুলে। বাদবাকি যে প্রার্থীরা নির্বাচনে আছেন, তারা প্রায় সবাই সরকারি দলের। সরকারি দল একটা প্যানেল দিয়েছে, আবার বিস্ময়করভাবে, নিজের দলেরই সদস্যদেরকে 'স্বতন্ত্র' প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ানোর অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। বিরোধীদের নির্বাচন বয়কটের চাপ সামলাতে এবং এ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশক্রমে নিজের দলেরই সদস্যদের 'ডামি' প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন! এ ঘটনা নজিরবিহীন। ফলে, বলা যায়, এ নির্বাচন এমন এক কৌশলে হতে চলেছে, যে বা যারাই নির্বাচনে জিতুক না কেন—তাদের সবাই হবে ক্ষমতাসীন দলের লোক!

তবে, সাধারণ জনগণের জন্য এই ছল-চাতুরি বুঝতে পারাটা খুব কঠিন কিছু নয়। এক তরফা নির্বাচন নিয়ে তাদের ভেতরে আর কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে সর্বপ্রকারে জোর-জবরদস্তি করে ভোটারদেরকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন চলছে। এক আইনজীবী  হাইকোর্টে রিট করেছেন—সরকারি সুবিধাভোগী সোয়া তিন কোটি সরকারি ও আধাসরকারি চাকরিজীবী ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে নিতে বাধ্য করার জন্য। আবার আমরা পত্রিকান্তরে এও দেখতে পাচ্ছি যে, জামালপুর-চট্টগ্রামে সরকারি দলের প্রার্থীরা হুমকি দিচ্ছেন, ভোট না দিলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সুবিধাভোগীদের কার্ড কেড়ে নেওয়া হবে! প্রতিবেদনে এই দুই অঞ্চলের ভয়ভীতির খবর এলেও আমরা বুঝতে পারি—সারাদেশেই এই প্রক্রিয়া চালু আছে।

এসব পরিস্থিতি আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমরা বুঝতে পারছি, বৃহত্তর জনগণ যেমন ভোটাধিকার বঞ্চিত হচ্ছে, একইসঙ্গে ভীতসন্ত্রস্তও হয়ে আছে। সবকিছুতেই জবরদস্তি দেখা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একে-অপরের মধ্যে ন্যূনতম যে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকে, তা একেবারে অনুপস্থিত। ফলে নির্বাচনের পরেও পরিস্থিতি কেমন হবে, তা নিয়ে জনমনে আতঙ্ক ও আশঙ্কা বিরাজ করছে। কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই জনগণকে শায়েস্তা করে রাখাই যদি সরকারের নীতি হয়ে থাকে, তবে তা থেকে সরে আসতে আমরা অনুরোধ করব। আমরা আশা করবো মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সব নাগরিকদের সার্বজনীন মানবাধিকার, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার সমুন্নত রেখে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার চেষ্টায় সকল পক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করবেন।

সবকিছু মিলিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৭ জানুয়ারি আমরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো অগ্রহণযোগ্য আরেক নির্বাচন দেখতে চলেছি এবং নির্বাচনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। দেশের অর্থনীতির অবস্থা ও ভূরাজনীতিক বিন্যাসে বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনায় এরকম প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেশের ভবিষ্যতকে গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আমরা এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা মনে করি, উদ্ভূত সংকটের সমাধান গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকেই করতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ