‘৫ ঘণ্টা সাঁতরানোর পর আর ভালো লাগছিল না’

রেজাউল করিম ইমরান
রেজাউল করিম ইমরান  © টিডিসি ফটো

সম্প্রতি বাংলা চ্যানেল পার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম ইমরান। ১৫তম “ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতার ২০২০” এর এবারের আয়োজনে ৪৩ সাঁতারুর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিলেন আটজন। তাদেরই একজন হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত ইমরান। তার এই অসাধ্য সাধনে ছিলো নানা রকম প্রতিবন্ধকতা, ছিলো অনেক চ্যালেঞ্জ। তবে দৃঢ়চেতা ইমরান সেই অসাধ্যকে সাধন করে হেসেছেন তৃপ্তির হাসি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের একাউন্টে দেয়া এক পোস্টে প্রায় ৬ ঘণ্টার এই সাঁতারের গল্প তুলে ধরেছেন ইমরান। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের উদ্দেশে বাংলা চ্যানেল পার হতে সাঁতারের অভিজ্ঞতা নিয়ে ইমরানের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো।

“আমি যদি আমার বাংলা চ্যানেলের পুরো কাহিনি বর্ণনা করতে যাই, একটা বড় ধরনের বই হয়ে যাবে, আমার প্র্যাক্টিসের ঘটনা শুনে অনেকে আঁতকে উঠতে পারেন এবং আমার বাবা মা ভবিষ্যতে কোথাও যেতে চিরদিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন। আমি শুধু বাংলা চ্যানেল জয় করার দিনের কথা শেয়ার করছি। আশা করি এখান থেকে অনেকে অনুপ্রাণিত হতে পারবেন।

প্রথমেই আমার ফার্স্ট স্ট্র্যাটেজিতে ভুল হয়। কথা ছিল আমি আর এক ছোট ভাই ইশাক একসাথে সাঁতার কাঁটব। গত তিন দিন আমরা একসাথে সমুদ্রে অনুশীলন করি। আমাদের স্ট্রোক একই রকম প্রায়। কিন্তু ইসহাক নামতে দেরি করে। ও বলছিল যে, টিমলিডার লিপটন ভাইয়ের সাথে একসাথে নামবে, যাত্রা শুরু করবে। আমি জানতাম যে, লিপটন ভাই সবার পরে নামবে। তাই ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি আস্তে আস্তে সাঁতার শুরু করি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই লিপটন ভাই অনেক এগিয়ে যায়, হাসান অনেক পিছনে পড়ে যায়।

দুই মিনিট পরেই দেখি আমার চোখের সাথে গগলস আর আটকাচ্ছে না! নোনাপানি চোখের ভিতরে ঢুকে পড়তেছে আর জ্বালাপোড়া করতেছে।বেশির ভাগ রেসকিউ বোট সামনে এগিয়ে যায়। আমার রেসকিউ বোট নাম্বার ছিল ২৬। আমি আর আমার রেসকিউ বোটকে খুঁজে পাই না। রেসকিউ বোট ব্যতীত সামনে এগিয়ে চলা দুঃসাধ্য। রেসকিউ বোট এর নিয়ম হচ্ছে সুইমারকে খুঁজে নেওয়া। সেখানে আমি রেসকিউ বোটকে খুঁজছি। পুরো গুলিস্তান ঘুরে আমরা ঢাবি সুইমিং টিমের সবাই সবচেয়ে ভালো গগলস নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এই গগলস দিয়ে গত এক সপ্তাহ প্র্যাক্টিস করেছি। কিন্তু ওইদিন এমনটা হবে কখনো ভাবিনি।

চোখে নোনাপানি ঢুকে জ্বালাপোড়া করার কারণে ভালভাবে সাঁতার কাটতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টার পরেও গগলস চোখে সাপোর্ট দিচ্ছিলো না।ওই অবস্থাই চোখ বন্ধ করে সাঁতার শুরু করলাম। আর কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে ছাব্বিশ ছাব্বিশ বলছিলাম। আশে পাশের বোটকে বলছিলাম ছাব্বিশ নাম্বার বোট খুঁজে দিতে। অবশেষে প্রায় ৩০ মিনিট পর আমি আমার রেসকিউ বোট খুঁজে পাই। গগলস পরিবর্তন করতেও ভালো রকম বেগ পোহাতে হয়। এত বড় একটা জার্নিতে ৪০ মিনিট সারভাইব করা ও সময় অপচয় হওয়া, আমার শরীর ও মনের অবস্থা তখন কি ছিল আশা করি বুঝতে পারছেন। আশে পাশে তখন আর কোন সুইমারকে বা কোন রেসকিউ বোটকে দেখতে পাইনি। একদম সবার শেষে থেকে আমার যাত্রা শুরু করি। নতুন গগলস পড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে সাঁতার কাটা শুরু করি। মনে হচ্ছিল পুরো সমুদ্রে আমি একাই পাড়ি দিচ্ছি। আসলে আশেপাশে কোন সুইমারকে দেখতে পেলে ভাল লাগা কাজ করে। কোন প্রকার না থেমে একটানা চার ঘণ্টা সাঁতার কেঁটে যাই।

গত তিন দিন জেলি ফিশের আক্রমণে অভ্যস্ত হওয়ায় শরীরের সাথে সয়ে গিয়েছিল। মাঝ সমুদ্রে অনেক জেলিফিশ আক্রমণ করে। হঠাৎ জেলি ফিশ আমার কানে এমনভাবে আক্রমণ করল যে, মনে হচ্ছিল আমার কানে একটা বোম ব্লাস্ট হয়েছে। তবুও সাঁতার থামাই নি। বাংলা চ্যানেলে পাড়ি দেওয়ার জন্য শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি আপনাকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড রকম শক্তিশালী হতে হবে। পুরো জার্নিতে আমি দুই মিনিটের মত রেস্ট নিয়েছি। এছাড়া পুরো সময় একটানা সাঁতার কেঁটে গিয়েছি। এখন সবাই আমাকে সরাসরি দেখলে না-ও চিনতে পারেন। শরীরের রং পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গেছে। মুখের খোলস ওঠে গিয়েছিল, দুইদিন ভালভাবে কিছু খেতে পারিনি। আমি আমার লক্ষ্যে পাহাড়সম অটল ছিলাম।

সাগরে আমার সাথে যে কোন কিছু ঘটতে পারে এটা ভেবেই সাগরে নেমেছিলাম। পাঁচ ঘণ্টা সাঁতারের পর সাঁতার কাঁটতে ভাল লাগছিল না। যেটা সবার ক্ষেত্রেই হয়, দ্বীপ দেখা যায়, তবে পথ আর শেষ হয় না। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে, আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমি চেষ্টা করে যাবো। একবারও মাথায় আনিনি গিভ আপ করার। সমুদ্রে মাসল পুল হওয়া একটা কমন ব্যাপার। আল্লাহর রহমতে আমার একবারও মাসল পুল করেনি।

আলহামদুলিল্লাহ। সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ৫ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট সাঁতার কেঁটে যখন সেন্টমার্টিনের তীরে এসে বালুতে হাঁটা শুরু করলাম, তখনকার অনুভুতি বলে বোঝাতে পারব না। বাংলা চ্যানেল আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক অনেক কিছু। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন, এখান থেকে উজ্জীবিত হয়ে, আমি যেন দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করতে পারি।
সেন্টমার্টিনে দ্বিতীয় দিন সমুদ্রে প্র্যাক্টিস করার সময় মাঝ সমুদ্রে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আশেপাশে কেউ ছিল না। ভয়ংকর সব ঢেউ আমাকে আছড়ে ফেলতেছিল। ঢেউয়ের সাথে পেড়ে উঠতে পারছিলাম না। এজন্য মনে একটু ভয় ঢুকে যায়। Arafat ভাই মানসিক ভাবে অনেক সাপোর্ট দেয়। আরাফাত ভাই আমার ফিটনেস গুরু। বঙ্গবন্ধু হলের শাহাদাত ভাই (প্রাক্তন বাংলা চ্যানেল বিজয়ী) সব সময় আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন ও বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। স্টাইল ঠিক করতে সহায়তা করার জন্য আমাদের ক্যাপ্টেন Rasel ভাইকে ধন্যবাদ। Musha ভাই বোটে আমাকে অসাধারণ অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা মুসা ভাই। রেসকিউয়ার রুবেল ভাইকে ধন্যবাদ ধৈর্য্য সহকারে আমার সাথে থাকার জন্য। আমার সুইম মেট সকল বড় ভাই Tanbir-ul ভাই, সুজন ভাই ও ছোট ভাই Tapu, Abadul, Rawnak, Abu Bakkar এর নিকট আমি কৃতজ্ঞ আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করার জন্য।

আমার বাংলা চ্যানেল এর স্বপ্ন ও ফ্রি স্টাইল সুইমিং এর হাতেখড়ি Lipton ভাইয়ের হাত ধরে। বাংলা চ্যানেল এর সাঁতারের জন্য সবাইকে চার ঘণ্টা সাঁতার কেঁটে শারিরীক সক্ষমতামূলক পরীক্ষা দিতে হয়। কোন কারণে আমি শিডিউল মিস করি। এজন্য টিমলিডার লিপটন ভাই আমার উপর পাঁচ ঘণ্টা সাঁতার ধার্য করেন। আমি জহুরুল হক হল পুকুরে ননস্টপ টানা ৫ ঘণ্টা ১৫ মিনিট সাঁতার কেঁটে উত্তীর্ণ হই।

আর অনুশীলনের কথা যদি বলি আমি একবিন্দু ও ছাড় দেইনি। সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকত, তখন আমার অনুশীলনের প্রস্তুতি শুরু হত (ভোর ৪টায়)। মার্চে এই প্রোগ্রামটা হওয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে মাত্র দুই দিন আগে সেটি ক্যানসেল হয়ে যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ফজর নামাজের পরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে যখন জহুরুল হক হল পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতাম, তখন মনে হত পানি কলিজার ভিতর দিয়ে ঢুকছে। তবুও অনুশীলন বন্ধ রাখিনি।

স্থগিত হওয়ার পরেও আমার অনুশীলনে থেমে থাকিনি। লকডাউনের সময় কুমিল্লাতে গ্রামে গিয়ে জাহিদ ভাইয়ের সাথে প্রতিদিন ১০-১২ কিলোমিটার দৌড়াতাম। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে গ্রামের বাচ্চাদের বেসিক মার্শাল আর্ট শিখাতাম। তারপর দুপুরে টানা সাঁতার কেঁটে ৫০-৬০ বার গোমতী নদী পার হতাম। এভাবে প্রায় দুইমাস অনুশীলন করেছি। বাংলা চ্যানেলের জন্য আমি কি পরিমাণ অমানুষিক পরিশ্রম করেছি, একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন। রাসেল ভাই ব্যতীত আমরা কেউ প্রফেশনাল সুইমার না, তবে আমাদের ডেডিকেশন লেভেল, মনোবল ছিল আকাশচুম্বী। আল্লাহর রহমতে আমার একটি ভাল গুণ হচ্ছে কোন প্রকার না থেমে টানা ৫ ঘণ্টা সাঁতার কাঁটতে পারি। সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার সাথে থাকার জন্য।

আপনি যদি আসলেই মন থেকে কিছু চেয়ে থাকেন, তাহলে আজই আল্লাহর উপর ভরসা কাজে নেমে পড়ুন। সাফল্য আসবেই ইনশাল্লাহ্।”


সর্বশেষ সংবাদ