০৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০৯

প্রত্যন্ত গ্রামে পড়াশোনা, প্রথম চেষ্টায় অ্যাডমিন ক্যাডার ডেন্টাল পড়ুয়া আজাদ

৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মো. আজাদ হোসেন সোহাগ  © সংগৃহীত

৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন (অ্যাডমিন) ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী মো. আজাদ হোসেন সোহাগ। পড়াশোনা শেষে সহকারী ডেন্টাল সার্জন হিসেবে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন তিনি। ২০২১ সালে এসে সিদ্ধান্ত নেন অন্য কিছু করার। প্রথম কোনো চাকরির পরীক্ষা দেন এবং সফল হন তিনি। ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।

আজাদের গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ির রামগড়ের উত্তর লামকুপাড়ায়। বাবার নাম মো. নুরুল আলম। তিনি কৃষি কাজ করেন। আজাদরা চার ভাই বোন। তিনি সবার বড়। তার প্রাথমিকের পড়াশোনা উত্তর লামকু পাড়া কমিউনিটি বিদ্যালয় থেকে শেষ করেন। এছাড়া মাধ্যমিক রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও উচ্চমাধ্যমিক ফেনী সরকারি কলেজ থেকে পাস করেন।

পরবর্তীতে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। সেখান থেকে পাস করে বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সহকারী ডেন্টাল সার্জন হিসেবে কর্মরত আছেন। জীবনে প্রথম কোনো চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ৪৩তম বিসিএসে। প্রথমবারেই প্রশাসন ক্যাডার পান। এছাড়া ৪৪তম এবং ৪৫তম প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

আজাদ হোসেন সোহাগ বলেন, পাস করার পরপর চিন্তা করতে থাকি কি কি ক্যারিয়ার অপশন আছে। ছোটবেলায় এলাকায় ইউএনও স্যারকে দেখে ইচ্ছে হতো এরকম অফিসার হওয়ার। তাই ২০২১ সালে এসে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। ফাইনাল পরীক্ষার পর বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করি। প্রিলিমিনারির জন্য বোর্ড বই এবং বাজারে প্রচলিত বেশীরভাগ বই পড়া হয়েছে। 

ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। সেখান থেকে পাস করে বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সহকারী ডেন্টাল সার্জন হিসেবে কর্মরত আছেন। জীবনে প্রথম কোনো চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ৪৩তম বিসিএসে। প্রথমবারেই প্রশাসন ক্যাডার পান। এছাড়া ৪৪তম এবং ৪৫তম প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

তবে পড়ার চেয়ে রিভিশন দেয়া এবং বেশি বেশি প্রশ্ন সলভ করা ও পরীক্ষা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। প্রিলিমিনারি প্রিপারেশন অনেক ভালো হওয়ায় রিটেন প্রিপারেশন নিয়ে তেমন একটা কষ্ট করতে হয়নি। এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস হতো না। পিছিয়ে পড়া এলাকা হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব ছিল না তেমন একটা। দু’দশক আগে যখন আমি স্কুলটিতে ভর্তি হই, এটি ছিল কমিউনিটি স্কুল। এলাকার লোকজন মজা করে বলতো, হুডা (ফুটো) স্কুল। 

আশেপাশে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী এবং অসেচতন বাবা-মায়েদের সন্তানকে এখানে ভর্তি করানো হতো জানিয়ে তিনি বলেন, পড়াশোনা নয়, এ আসা-যাওয়া ছিল পঞ্চম শ্রেণি পাস সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য। স্কুলটির মজার কোনো বিষয় ছিল না। ছিল না পড়ালেখার চাপও। না ছিল স্কুলে উপস্থিত থাকার যন্ত্রণা। আমরা বই কাঁধে চেপে স্কুলে যেতাম।

তিনি আরো বলেন, বারান্দায়, মাঠে, পাহাড়ি ঢালে খেলে ক্লান্ত হতাম। স্কুলের আশেপাশে জঙ্গল, পাহাড়, স্লুইস গেট থাকায় ছেলে-মেয়ে দলবেঁধে ওখানে গিয়ে খেলতাম। হই হল্লা করতাম। স্কুলের ইউনিফর্ম ছিল না, তাই ইউনিফর্ম ময়লা হওয়ার ভয়ও ছিল না। স্কুলের চাবির গোছাও আমাদের কাছেই থাকতো। স্কুল খোলার দায়িত্ব কখনো আমার, কখনো অন্য কারো ছিলো। এক রুমে ক্লাস হতো তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির। শিক্ষার্থী সংখ্যা এত কম ছিল যে, তাও ক্লাস খালি থাকতো।

সোহাগ বলেন, দুপুরে ক্ষুধা লাগলে বাসায় চলে যেতাম। স্যার ম্যামদের বেতন নামমাত্র ছিল। সবাই একসঙ্গে আসতেন না। অনেক সময় আমি নিচের ক্লাসগুলোর শিক্ষক হয়ে যেতাম। এভাবে করতে করতে পঞ্চম শ্রেণিতে যখন উঠি, আমি তখনো ইংরেজি পড়তে জানি না। আমি জানি না কিভাবে জ্যামিতি আঁকতে হয়। জানি না পরীক্ষার খাতায় ঠিক কীভাবে লিখতে হয়।

আরো পড়ুন: বাবা ছিলেন প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ হলেন ছেলে

একবার স্কুলে এসেছিলেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার। ততদিনে সোহাগ মডেল টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করে। শিক্ষা অফিসার তার হাতের লেখা দেখে অবাক হন। কিছু প্রশ্ন করার পর তার কি মনে হলো, সে দিনটি জীবনে বদলানো দিন বলে মত তার। তিনি বলেন, ‘উনি পাশের সরকারি স্কুলে একমাস পড়তে দেয়ার সুযোগ করে দিলেন। মামারা শিক্ষক হওয়ায় উনাদের কাছেও আমার ব্যাপারে বললেন। অল্প কয়দিনের গাইডেন্সে আমি পিএসসিতে এ প্লাস পাই। রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে চ্যান্স পেয়ে যাই। 

চান্স পাওয়ার পর মামার বাসায় চলে আসেন সোহাগ। তবে যৌথ পরিবার হওয়ায় পড়ার পরিবেশ ছিল না। হাইস্কুলে কিছু শিক্ষক অনেক ভালোবাসতেন তাকে। একজন ছিলেন হারুন অর রশীদ। তিনি ফ্রি পড়াতেন। তার জীবনে প্রথম বড় অর্জন ছিল- প্রথমবার অনুষ্ঠিত হওয়া জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া। পুরো উপজেলায় তিনি ছিলে একমাত্র, আর জেলায় মাত্র তিন জন।

এরপর এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পাওয়ার পর ফেনী সরকারি কলেজে ভর্তি হন। তবে অর্থাভাবে লজিং টিচার হিসেবে একটি বাড়িতে ওঠেন। তাদের সন্তানকে তিন বেলা পড়ানো ও টিউশনি করে ইন্টারমিডিয়েট শেষ হয়। তখন কোনো প্রাইভেট পড়তে পারেননি। মেডিকেল ভর্তি কোচিংও করতে পারেননি। তবে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে চান্স পেয়ে ভর্তি হন। এরপর টিউশনি করে চলেছে।

শিক্ষাজীবনে কাদের সাহায্য পেয়েছেন এবং কাদের ধন্যবাদ দিতে চান জানতে চাইলে আজাদ হোসেন সোহাগ বলেন,  নিজের প্রচেষ্টা ও সবার ভালোবাসায় এতদূর আসা। আমার সফলতার পেছনে সে সমস্ত মানুষ আছেন, যারা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোনো না কোনো সহযোগিতা করেছেন। তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আপনি যখন চেষ্টা করবেন, কিছু পেতে চাইবেন- দেখবেন পুরো দুনিয়া আপনাকে সে লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার আয়োজন করে দেবে।