ইউআইইউতে চাকরি, ইউআইইউতেই পড়াশোনা
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ৭ম সমাবর্তনে সনদ পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৫৪ জন গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের শিক্ষার্থী। তবে তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম মো. আনিসুর রহমান লিখন।
২০১৩ সালে মফস্বল এলাকা থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পেরোনো লিখন যখন জামালপুর ছেড়ে ঢাকায় আসেন, তখন তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল চাকরি করা। উচ্চশিক্ষার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও পারিবারিক অভাব-অনটনই এ পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তবে হাল ছাড়েননি লিখন। সেবছর ইউআইইউতে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরিরত অবস্থায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ইউআইউর সপ্তম সমাবর্তনে ৩ হাজার ৯৫৪ শিক্ষার্থী, স্বর্ণপদক পেলেন ৪ জন
লিখন বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেও পারিবারিক সমস্যার কারণে ভর্তি হতে পারিনি। কিন্তু আশা ছিল উচ্চশিক্ষা অর্জনের, তাই হল ছাড়িনি। পরবর্তীতে স্নাতকে পড়ালেখার অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে চালিয়ে যাওয়ার মনস্থির করি। এরই ধারাবাহিতকায় ইউআইইউতে চাকরিরত অবস্থায় ২০১৪ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হই এবং ২০১৮ সালে স্নাতক সিজিপিএ ২.৭৬ নিয়ে শেষ করি সেখান থেকে।
এসএসসি ও এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্পন্ন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে লিখনের মন বসেনি। এজন্য আরও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেন তিনি।
লিখন বলেন, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। তাই স্নাতকের বিষয়টি নিয়ে মন বসেনি আমার। তাহলে আমার ট্র্যাকটি চেঞ্চ করা দরকার বলে তখন মনে হয়। এজন্য জাবিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা আইটিতে ভর্তি হয়। সেখানে ২০২০ সালে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা শেষ হলেও করোনার কারণে ২০২৩ সালে ফল প্রকাশ করা হয়। সেখানে আমি সিজিপিএ ৩.৮১ পেয়ে উত্তীর্ণ হই।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সমাবর্তনে লিখন
২০২০ সালে জাবি থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা শেষ করার পর লিখন ভাবেন, তার পড়াশোনা এখানেই শেষ নয়। তাকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে হবে। তখন একটা সুযোগ আসে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন অর্থাৎ ইউআইইউর মাস্টার্স অব কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাইবার সিকিউরিটিতে ভর্তি হওয়ার। ২০২০ সালের সামারে সেখানে ভর্তি হয়ে স্প্রিং ২০২২ সালে তার মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ হয় তার। সিজিপিএ ২.৭০ ছিল এ যাত্রায় অর্জন।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার উৎসাহ কীভাবে এমন প্রশ্নে লিখন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশি উৎসাহ পেয়েছি। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলাম, তখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়তাম। সেসময় আমার ল্যাব ছিল তখন ইইই ও সিইসি বিভাগে। ল্যাবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তখন আমি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শুনতাম এবং শিখতাম। তখন তারা বলতো, আপনি তো দেখি পারেন এবং তারা আমাকে এগিয়ে নিতে (শেখাটা কন্টিনিউ করতে) বলতেন। সেই সূত্র ধরেই পরবর্তীতে জাবিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা আইটিতে ভর্তি হই এবং এখানে এমএসসিতে ভর্তি হই। তাই শিক্ষার্থীরাই আমার উৎসাহের মূলে।
আরও পড়ুন: এবার স্বপ্ন তাদের আকাশ ছোঁয়ার
“যখন ইউআইইউতে ভর্তি হতে যাই, তখন প্রফেসর নূরুল হুদা স্যারের (সিএসই হেড) কাছে গিয়ে এখানে ভর্তি হতে পারি কিনা জিজ্ঞেস করি। তখন উনি আমার অ্যাকাডেমিক কাগজপত্র দেখে বললেন, ভর্তি হতে পারেন। ভর্তি হয়ে যান, কোনো সমস্যা হবে না। প্রথমেই আমি উনার উৎসাহ পাই এবং এখানে ভর্তি হয়েছি।”
তবে লিখন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলা থেকে। তিনি বলেন, পড়াশোনা কিংবা আইটি নিয়ে উচ্চশিক্ষা সবাই অনুপ্রেরণার মূলে ছিলেন বাবা। তিনি সেনাবাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে চাকরিরত অবস্থায় সাইবার টেকনিক বা নেটওয়ার্ক সিকিউরিটির থিওরিগত শিক্ষা দিয়েছিল। আমি এটার সূত্র ধরেই সাইবার সিকিউরিটিতে মাস্টার্স করি।
মো. আনিসুর রহমান লিখন
বাবার সেনাবাহিনীতে চাকরির সময় লিখনের ৪ ভাইবোনের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। কিন্তু অবসরের পর পেনশনের টাকা দিয়ে ব্যবসা করলে সেখানে লোকসান হয়। সেটাই যেন বলা যায় লিখনের জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’।
তিনি বলেন, বাবা মুক্তিযোদ্ধা। সেনাবাহিনীতে চাকরি শেষ হওয়ার পর অবসরে যান তিনি। তখন ওনার পেনশনের টাকা ব্যবসাতে খাটানোর পর লোকসান হয়। পরে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়েন বাবা। তাই ভাবলাম এইচএসসির পর চাকরি করতে হবে। ফ্যামিলি তো আর সাপোর্ট দিতে পারবে না। এজন্য ঢাকায় এসে ইউআইইউতে চাকরি শুরু করি।
লিখনের স্বপ্ন শিক্ষকতা করার। তবে সেটি বাঁধ সেজেছে তার অ্যাকাডেমিক ফল এবং ব্যাকগ্রাউন্ড ডাইভার্ট নিয়ে। ২০১০ সালে লিখন জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলা মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৫০ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১২ সালে একই উপজেলার হাবিবুর রহমান কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৩৫ পেয়ে এইচএসসি সম্পন্ন করেন।
তিনি বলেন, শিক্ষকতা পেশাটা বেশি ভালো লাগে আমার। কিন্তু অ্যাকাডেমিক ফলাফল অত ভালো নয়। তাছাড়া আমার ব্যাকগ্রাউন্ডও ডাইভার্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স, আইটিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা, সিইসিতে মাস্টার্স। কিন্তু যারা শিক্ষকতা করবে তাদের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হয়। যেটা আমার নেই। সেক্ষেত্রে টিচিং না হলে ওই রিলেটেড কিছু পেশায় যুক্ত হওয়ার করবো। কিছু জায়গাতে চাকরির জন্য চেষ্টা করছি।
সন্তানের সঙ্গে লিখনের খুনসুটি
ইউআইইউ থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর বিয়ে করেছেন লিখন। বর্তমানে একটা মেয়ে আছে তার। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বলেন, তাকে পড়াশোনা করাবো। আমার ইচ্ছে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, সেখানে আমার সন্তানসহ সবাইকে শিক্ষা দিতে পারবো। সেই যোগ্যতা আমার আছে।
২০১৩ সালে ইউআইইউতে চাকরিতে যোগদানের পর শুরুতে ক্লাসরুমে সার্ভিস দিতেন লিখন। তারপর ল্যাবেও কাজ করতে থাকেন তিনি।
লিখন বলেন, ল্যাবের অভিজ্ঞতা থাকায় ক্লাসরুমে সার্ভিসের পাশাপাশি ল্যাবেও কাজ করতাম। চাকরি ও পড়াশোনার পাশাপাশি আমি কিছু কাজ করেছি।
“আমি তখন দেখেছি অনেক শিক্ষার্থী প্রোগ্রামিং কাজ করে কিন্তু ভালো করে বুঝে না। তখন আমি বাংলায় প্রোগ্রামিং রচনার করার চেষ্টা করি। দুই ধাপে দুটি প্রোগ্রামিং করি একটা হলো বাংলা থেকে পাইথন কোড, আর আরেকটি হলো বাংলা থেকে সি কোড।“
“তারপর ইউআইইউর অনেক শিক্ষার্থীর কাছে শুনেছি তাদের কাছে প্রোগ্রামিং ট্রেসিংটা খুবই কঠিন মনে হতো। সেজন্য প্রোগ্রামিং২৪ নামে একটি ওয়েবসাইট বানিয়ে সেখানে প্রোগ্রামিং ম্যানুয়েল ট্রেসিং নামে কিছু কোর্স রাখি। এখানে ফ্রি কোর্স সেখানে প্রত্যেকটা কোড কীভাবে কাজ করে সেই অনুপানে অ্যালগরিদম ফ্লোচার্টের মাধ্যমে শেখা যাবে। এছাড়াও বাংলা ও ইংরেজিতে কবিতা লেখা হয় আমার।”
রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানী ঢাকার বাড্ডায় সবুজে ঘেরা বিশাল ক্যাম্পাসের ২০ বিঘার মাঠে ইউআইইউর এই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পক্ষে তার প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ৩ হাজার ৯৫৪ জন শিক্ষার্থীকে গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি এবং কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য চারজন শিক্ষার্থীকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে খুশি লিখন। তিনি বলেন, আশা ছিল সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাবো। সেটা আজ পূরণ হয়েছে। আমি এখানে আমার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে এসেছি।