বিসিএস ক্যাডার না হলে দিপককে পাড়ি জমাতে হতো অস্ট্রেলিয়ায়
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ’র (আইসিডিডিআর,বি) ভাইরোলোজি গবেষণাগারে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন দিপক কুমার শীল। তিনি চাকরি শুরু করেন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন থেকেই চাকরির পাশাপাশি বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। তাঁর মেধাক্রম ৭১। এই বিসিএসে ক্যাডার না হলে উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।
দিপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ৩৭তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়া ক্যাম্পাসের সিনিয়র ভাইকে দেখেই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নটি বুনেছিলেন তিনি।
দিপক বলেন, আমার বাবার স্বপ্ন ছিল আমি যেন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হই। আমার অ্যাকাডেমিক বিষয়ে সরকারি চাকরিতে পদ কম থাকলেও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সফল হইনি নানাবিধ কারণে। যদিও আমার অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট বেশ ভালো। অনার্সে সিজিপিএ ৩.৯১। মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৯০। পাশাপাশি গবেষণাপত্রও ছিল। এর ফলে আমার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রত্যয় আরো দৃঢ় হয়।
দিপক বলেন, আমি ২০১৯ সালে আইসিডিডিআর,বি’র ভাইরোলোজি ল্যাবরেটরিতে যোগদান করি। আমার অফিসের গাড়ি ধরতে প্রতিদিন সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে শুরু হতো দিন। তারপর ৫টায় অফিস শেষ করে একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস করে বাসায় পৌঁছে পড়তে বসতে প্রায়শই ১১টা বেজে যেত। আবার আগামীকাল একই সময়ে অফিস। আমি নিজের অজান্তেই অনেকবার টেবিলে ঘুমিয়ে পরতাম।
তিনি আরো বলেন, আমি শুধু এটিই ভাবতাম যে, আমাকে প্রতিযোগিতা করতে হবে পরিশ্রমী মেধাবীদের সঙ্গে। যেটি ভেবেই ঘুম ভেঙে যেত। চাকরি করে আর্থিক স্বচ্ছলতা আসলেও পড়ালেখার সময় ছিল সীমিত। যার দরুণ আমার প্রস্তুতি ছিল প্রশ্ননির্ভর। অর্থাৎ আমি দেখতাম, যে ক্ষেত্রগুলো থেকে নিশ্চিত প্রশ্ন করা হয়, সেগুলো ভালোভাবে পড়তাম।
প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মূলত পরীক্ষার্থী বাছাই পরীক্ষা। তার মূল লক্ষ্য ছিল তথ্যসূত্র যাচাই করে ঠিক তথ্য মনে রাখা। দিপক বলেন, নিয়মিত পত্রিকা পড়ার সময়ের অভাবে আমি সম্পাদকীয় সমাচার নামক বই নিয়মিত পড়তাম। অধিকন্তু, নিয়মিয় প্রশ্নআসন্ন বিষয়গুলো কোচিংয়ের শিক্ষকদের ক্লাস লেকচার খুব ভালোভাবে পড়ার পাশাপাশি সমসায়িক চাকরির প্রশ্ন দেখতাম। লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমেই ক্যাডার নির্ধারিত হয়। এটি প্রিলিমিনারির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার লক্ষ্য ছিল, কোনো প্রশ্ন না ছেড়ে সকল প্রশ্নের উত্তর সময়ের মধ্যে করা এবং উত্তর তথ্যবহুল ও জটিলতা বিবর্জিত রাখা।
অসংলগ্নতা পরিহার করে যৌক্তিক উত্তরই মূলই নম্বর পেতে সহায়তা করে। ভাইভার ক্ষেত্রে চতুরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমার প্রথম পছন্দ পররাষ্ট্র ক্যাডার হওয়াতে আমার সম্পূর্ণ ভাইভা ইংরেজিতে হয়। আমাদের কূটনৈতিক মিশনের অর্জন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায় পদক্ষেপই ছিল আমার ভাইভার মূল বিষয়। পাশাপাশি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এবং দেশকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপনে সাহিত্যের ভূমিকা।
একটি চাকরির ভাইভাতে তাকে বিষয় বহির্ভূত উপলক্ষ্য নিয়ে অপমান করা হয় জানিয়ে বলেন, এটি আমাকে চাকরি পেতে এবং নিজেকে আরও বেশি উপযুক্ত করতে অনুপ্রেরণা জাগায়। পাশাপাশি, বিভাগের বড় ভাইয়ের পররাস্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়া, বাবা মায়ের ইচ্ছা এবং দেশে থাকার প্রবল আগ্রহ অনুপ্রেরণা জোগায়।
বিসিএসের ফলাফলের পর অসাধারণ এক অনুভূতি ছিল, যেটি ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। সারাদিন ফলাফল হবার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। যার দরুণ অফিসের কাজে মন দিতে পারছিলাম না। ইতোমধ্যে আমার অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করার সুযোগ হয়। আমার মনে সংশয় ছিল যে, বিসিএস না হলে আমকে বিদেশে পাড়ি জমাতে হবে। দিনশেষে মনে হচ্ছিল, আজ আর ফলাফল হবে না। কিন্তু অপেক্ষার অবসান ঘটল ঠিক সন্ধ্যা ৭টা ২৩ বা ২৪ মিনিটে ফলাফল প্রকাশের খবর শুনেই, যোগ করেন দিপক।
আরো পড়ুন: এসএসসিতে জিপিএ-৩.২৫— ব্যর্থতা আর জেদ থেকে বিসিএস জয় আনিসুরের
তিনি বলেন, তখন আমি বাসায় যাচ্ছি অফিস থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বিপিএসসি’র ওয়েবসাইট থেকে ৪১তম বিসিএসের ফলাফলের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ডাউনলোড করে খুজতে থাকি নিজের রোল নম্বর। প্রথম পছন্দ পররাষ্ট্র ক্যাডারে নিজের রোল না পেয়ে সংশয় আরো বাসা বাঁধতে শুরু করল। তারপর ছুটে গেলাম বিসিএস (প্রশাসন) এর সিরিয়ালে। তখন খুঁজে পেলাম নিজের রোল নম্বর ৭১তম সিরিয়ালে। সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে যেন এক অসাধারণ আনন্দ চলে আসল। এতটাই যে চোঁখ দিয়ে পানি চলে আসে। আমার বাবা-মা কে জানালাম। আমার ভাই আমাকে ফোন করে জানালো আমার ফলাফল (ওর কাছেও আমার রোল নম্বর দেয়া ছিল)। এ এক অসাধারণ প্রশান্তি।
স্কুল, কলেজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্জান বিভাগে ভর্তি হয়ে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন দিপক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বন্ধু, বন্ধবী পান। তাদের সঙ্গে আলোচনা, প্রস্তুতি এবং শিক্ষকদের আন্তরিক ব্যবহার তাকে নতুন মাত্রা দেয়। সেখান থেকেই তার পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ অনেক বৃদ্ধি পায়। প্রজাতন্ত্রের একজন নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হওয়া ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তার। পাশাপাশি, উচ্চশিক্ষা গ্রহণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।
বিসিএস দিতে ইচ্ছুকদের উদ্দেশ্যে দিপকের পরামর্শ, অপ্রয়োজনীয় তথ্য কম পড়া। বিগত বিসিএসের প্রশ্ন দেখে তারপর প্রস্তুতি শুরু করা। নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করা। তথ্যসূত্র জেনে ঠিক তথ্য মনে রাখা। লক্ষ্য স্থির করে অধ্যবসায় করা। পরিশেষে, দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং ধৈর্যশীল হওয়া। মোটাদাগে এসব বিষয়াবলি মেনে বিসিএস যাত্রা শুরু করলে সফলতা অর্জনের পথে একধাপ এগিয়ে থাকা যাবে।