প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, আ.লীগের বৈঠক কিছুতেই সংকট কাটছে না ছাত্রলীগে
১৯ ‘বিতর্কিত’ খুঁজে পেয়েছে ছাত্রলীগ
- ইরফান হক
- প্রকাশ: ২৭ মে ২০১৯, ০৭:৩৪ PM , আপডেট: ২৮ মে ২০১৯, ০৭:৩১ PM
দুই সপ্তাহ আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা এখনও কাটেনি। কমিটি থেকে বির্তকিতদের বাদ দেওয়া, পদবঞ্চিতদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিতদের সংবাদ সম্মেলনে হামলা- এই তিনদফা দাবি পূরণে গত ২০ মে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা আশ্বাস দিলেও তা পূরণ না হয়নি।
এজন্য রোববার মধ্যরাত থেকে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়ারা ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নিয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি আসন্ন ঈদের দিনও তারা সেখানে অবস্থান করবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে, এ সংকটের মধ্যেই সোমবার দুপুরে নবগঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির সবাইকে নিয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পক অর্পণ করেছেন। এ সময় বিতর্কিতরাও ছিলেন বলে জানা গেছে। তবে আন্দোলনকারীদের কেউ সেখানে ছিলেন না।
জানা যায়, রোববার রাত ১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেয় সংগঠনটির পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা। তারা কর্মসূচীর বিষয়ে সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন। এসময় সংগঠনটির গত কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘আমরা এখানে অবস্থান করব, ঈদ আমরা ঢাকায় করার প্রস্তুতি নিয়েছি। যদি আমাদের এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না দেওয়া হয়, তাহলে আমরা রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করব। ঈদের দিন আমরা রাজু ভাস্কর্যে থাকব।’
গত কমিটির ঢাবির রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বি এম লিপি আক্তার বলেন, ‘আমি সবার সঙ্গে আছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দাবি না মেনে নেওয়া হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানে অবস্থান করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মূল দাবি হলো ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, মাদকাসক্ত, বিবাহিত, জামায়াত-শিবির পরিবারের যারা, তাদেরকে কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৭ জনের একটি লিস্ট দিয়েছেন। ১১ দিন আগে তাদের নাম ঘোষণা করা হলেও তাদের পদশূন্য ঘোষণা করা হয়নি এবং তাদের নিয়ে ফুল দিতে যাওয়া হয়েছে।এই ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
লিপি বলেন, ‘ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর একটি পবিত্র জায়গা। সেখানে জাতির কলঙ্কিত যারা, তাদের নিয়ে কোনোভাবে ফুল দিতে যেতে পারে না ছাত্রলীগ। এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। এ সময় পাশে অবস্থান করা ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা ‘শেইম, শেইম’ বলে নিন্দা জানান।’
কর্মসূচিতে গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন, সমাজসেবা সম্পাদক রানা হামিদ, উপদপ্তর সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, স্কুল ছাত্রবিষয়ক উপ সম্পাদক সৈয়দ আরাফাত, সদস্য তানভীর হাসান সৈকত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি প্রকাশের প্রায় ১০ মাস পর গত ১৩ মে ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া ছাত্রলীগের গত কমিটির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা তাদের ওপর হামলা চালান। এতে কয়েকজন নারী নেত্রীসহ ১০-১২ জন আহত হন। এ ঘটনা নিয়ে আন্দোলনে নামেন পদবঞ্চিতরা। পরে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আশ্বাসে তারা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান।
যদিও মধুর ক্যান্টিনের সেই ঘটনায় ২০ মে রাতে পাঁচজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। তবে পদবঞ্চিতরা বলছেন, হামলার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি জড়িতদের বিরুদ্ধে যথায ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ওই হামলা আহত একজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্কিতদের নিয়ে পদবঞ্চিতরা সরব হলে ১৫ মে দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে ওই দিন মধ্যরাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিতর্কিতদের বহিষ্কারে ২৪ ঘণ্টা সময় নেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।
সেখানে চিহ্নিত ১৭ জনের মধ্যে বিতর্কিত ১৬ জনের নামও প্রকাশ করেন তারা। সেই ঘোষণার এক সাপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঈদের আগে বিষয়টির সুরাহা হবে।
গত ২০ মে রাতে ধানমণ্ডি আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে দলের চার জ্যেষ্ঠ নেতা ও ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠকের পর এক সপ্তাহ ধরে চালিয়ে আসা বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া ছাত্রলীগের গত কমিটির নেতারা।
ওই বৈঠকে তদন্তের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কমিটির ‘বিতর্কিত’ পদগুলো শূন্য ঘোষণা করে যোগ্যতার ভিত্তিতে সেসব পদ পূরণ করার পাশাপাশি মধুর ক্যান্টিনে মারামারির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয় বলে জানান পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা। এসময় পদবঞ্চিতদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতেরও আশ্বাস দিয়েছিল আওয়ামীলীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এক সপ্তাহ তাদের আশ্বাসের প্রতিফল না হওয়ায় রোববার মধ্যরাত থেকে রাজু ভাষ্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেয় সংগঠনটির পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা।
গত কমিটির স্কুল ছাত্রবিষয়ক উপ-সম্পাদক সৈয়দ আরাফাত বলেন, ‘কমিটি গঠনের পর থেকে ছাত্রলীগে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা এখনও কাটেনি। কমিটি থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়াসহ যে তিনটি দাবি ছিল, তার একটিও পূরণ হয়নি। তাই ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নিয়েছে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়া নেতারা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করা হবে বলে তিনি জানান।’
মঙ্গলবার দুপুরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, যে ১৬ জনের নাম তাঁরা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তাদের ৮ জন নিজেদের পক্ষে দালিলিক তথ্য-প্রমাণ দিয়েছেন যে তাঁরা নির্দোষ। তাদের বাইরেও কয়েকজনের ব্যাপারে তাঁরা আপত্তি পেয়েছিলেন। সব মিলিয়ে ১৯ জনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, তাদের ব্যাপারে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন আছে। প্রাথমিকভাবে আজ ওই ১৯ জনের পদ শূন্য ঘোষণা করা হবে।
‘বিতর্কিতদের’ বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে রাব্বানী বলেন, ‘এই ১০-১২ দিন আমরা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাহায্য নিয়ে এই কাজটি করেছি, যাদের সম্পর্কে সন্দেহ হয়েছে যাচাই করে দেখেছি। ১৯ জনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা গেছে। পদবঞ্চিতরা যে কমিটিকে বিতর্কিত বলছেন, সেটি তাদের পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড হতে পারে, কিন্তু আমাদের তো যাচাই করা দরকার।’