‘এই সরকার ব্যর্থ হবে—এটা দেশবাসী হতে দিবে না’
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় লিখতে গেলে তো অনেক বিস্তারিত লিখতে হবে। উত্তরবঙ্গ বৈষম্যের শিকার, আমি বলবো দক্ষিণবঙ্গ বৈষম্যের শিকার—এসবের মধ্যে আমার কাছে কোনোটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। একটা দেশ স্বৈরাচারী কায়দায় চলেছিল দীর্ঘ ১৫ বছর। বিভিন্ন দল আন্দোলনে ছিল; তবে এটা সত্য যে, তারা বারবার ‘ফেইল’ করার কারণেই স্বৈরাচার দীর্ঘ ১৫ -১৬ বছর টিকে ছিল। অবশেষে স্বৈরাচারের পতন হলো—কীভাবে হলো?
কোটা আন্দোলন থেকে সূচনা—আন্দোলনে সমর্থন জানাই বিগত ১৪ জুলাই, ‘রাজাকার’ বলার পরে। আমি ঢাবির হলের সেই ‘রাজাকার’‘ পোস্ট শেয়ার করে লিখি ১৮ কোটি মানুষের সাথে রাজাকার হওয়া গর্বের।’ মূলত রাজাকার বলাতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দেশের মানুষ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের মধ্যেই #আমি রাজাকার গ্রুপ খোলা হয়। ১৫ জুলাই ক্যাম্পাসে সবার মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল, এরপর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) ৮নং গেটে গিয়ে রিফাত ৪টা প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসে, আমি তার সাথে আরও কিছু অর্থ যুক্ত করে প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসে প্রতিবাদী ভাষাগুলো বলি, আর তখন তা মুনিম লিখে।
তখন সহযোদ্ধা কম হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাজা এরিয়াতে গিয়ে সবাইকে নিয়ে ৮নং গেইট থেকে আন্দোলন শুরু করবো। ১২টা ৫ মিনিটে ক্লাস শেষ হয়, এর মধ্যেই প্রক্টর স্যাররা এসে প্লাজাতে দাঁড়ানো নিয়ে বাকবিতণ্ডা শুরু করে। আমি আমার অবস্থানে অনড় রই। ম্যামকে খুব ভালোভাবে আমাদের অধিকারগুলো বুজাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এরপর অনেককেই সাথে নিয়ে ৮নং গেটে স্লোগান শুরু করি।
আগামীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের বিকল্প নাই। তবে উপদেষ্টা পরিষদে পরিবর্তন আনতে হবে। বিতর্কিতদের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বহিষ্কার করতে হবে। আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের আত্মমর্যাদারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আমার ব্যাগে ২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশের একটা পতাকা বহন করি। সেই পতাকা দিয়েই ব্যানারের মতো মিছিলের সামনে নিয়ে মোটামুটি ৫০-৬০ জন নিয়ে অগ্রসর হই। এরই মধ্যে আমার এক গণমাধ্যমকর্মী বন্ধুকে ছবি পাঠাই। সে ‘আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংহতি’ এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। এরপর আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হওয়া এবং সমন্বয়কদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আমার সে বন্ধু আমাকে বেশকিছু সহায়তা করেছে।
সেদিন আমরা মিছিল নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেট (প্রগতি সরণি) ব্লকেড করি ২-৩ ঘণ্টার মতো)। তখন আমাদের সে সংবাদ দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমেই প্রকাশ করা হয়। এরপর বেলা ৩টার দিকে প্রোগ্রাম শেষ করে সবাইকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। ক্যান্টিনে এসে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সহযোদ্ধাদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে সবার সাথে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করবো বলে আমি চলে যা-ই ঢাবির টিএসসিতে।
এরই মধ্যে নিউজ আসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম টিএসসির এখানটায় হয়ত ছাত্রলীগ নাই। তবে অনুমান ভুল ছিল—ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের মধ্যেই আমি নেমে যায়। ভয়ে তখন হাত-পা কাঁপা-কাঁপি অবস্থা। তাঁদের সবার হাতে দেশীয় অস্ত্র। তখন আমি বুদ্ধি করে সাংবাদিকদের মধ্যে চলে যাই। পরে তাদের সাথে রিকসায় ঢাকা মেডিকেল আহত ভাইবোনদের দেখতে যা-ই।
আহত শিক্ষার্থীদের আহাজারি হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সহ্য করতে পারছিলাম না। টুকটাক আহতদের হেল্প করার চেষ্টা করি। অন্যদিকে মহিউদ্দিন রনির সাথে কথা হচ্ছিল—শহিদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগ হামলা করছে পালটাপালটি ইটপাটকেল ছোটাছুটি হচ্ছিলো। আমাকে বলে, ‘শান্ত ভাই আপনি হাসপাতালের দিকে থাকেন।’ তখন আমি হাসপাতালের দিকে অবস্থান করি। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ হামলা করে হাসপাতালে ইমার্জেন্সি গেটে আমরা ১০-১৫ জন হইলে পালটা মার দিতে পারতাম। তবে সাহসী কেউ ছিল না, সবাই কমবেশি আহত।
হামলার শিকার হবো, তখন প্রায় দৌড়ে চলে যাই দুই নম্বর বিল্ডিং এ। ঢামেকের নতুন বিল্ডিং হিসেবেই বেশি পরিচিত এটি। পরে ইমার্জেন্সির এখানেই অবস্থা করি রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত। পরে একটি বাইক নিয়ে সেখান থেকে বাসায় ফিরি। ‘আমরা রাজাকার’ গ্রুপে সবসময় আলোচনা চলতেই থাকতো। হোয়াটসঅ্যাপ ও কথা হয় আমাদের কিছু শিক্ষার্থীদের।
এরপর রাতেই সারজিস আলম ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়। আমাদের ১৫তারিখ আন্দোলনের কথা জানাই, পাশাপাশি নতুন কি চিন্তা নিয়েও। আগামীকাল কীভাবে কর্মসূচি করলে ভালো হবে—এও বিষয়ে কথা হয়। পরে ব্লকেড কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কথা জানান তিনি।
আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার আন্দোলনে নামলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
গ্রুপে ও হোয়াটসঅ্যাপে ১৬তারিখ ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ব্লকেড কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এরপর ১৬ তারিখ সকালে এনএসইউ ৮নং গেটে আমরা জড়ো হই। আমাদের সঙ্গে তখন যুক্ত হয় এআইইউবি, আইইউবি; তখনই পুলিশ বাঁধা দেয়। ঠান্ডা মাথায় তাদের সাথে কথা বলি। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকি, পরে স্লোগান শুরু, মিছিল নিয়ে বসুন্ধরা গেটে (প্রগতি সরণি) ব্লকেড করি। সকাল ১০থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে বক্তব্য রাখি বহুবার। তখন আসিফ মাহতাব স্যার আমাদের মাঝে বক্তব্য রাখে।
আন্দোলনে সমর্থন ও সকল শিক্ষকদের অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানান তিনি। স্লোগান দিচ্ছি এরই মধ্যে খবর আসে আবু সাইদ ভাই শহিদ হয়েছে। মগজে আগুন জ্বলে উঠে, মাইকে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলি ‘ছাত্রসমাজ উত্তপ্ত আগুন! আগুন নিয়ে খেলবেন না! আপনাদের ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ আমাদের সাথে আরও অনকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়। তখন সবার সাথে কন্টাক্ট নাম্বার বিনিময় ও পরবর্তী যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি হয়।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত না খাওয়া ক্লান্ত শরীর আন্দোলন শেষ বক্তব্য দিয়ে ফেরার সময় একটা রিকশায় উঠি বসুন্ধরা চেকপোস্ট থেকে। যে-ই ভাই মাত্রই রিকশা দিয়ে আসলেন তিনি আমার রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলেন। জানালেন আপনারা ভালো কাজ করছেন। তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট সাধারণ মানুষের সমর্থন। রাতে সারজিস আলম ভাইয়ের সাথে কথা হয় কালকে কী করবো? রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলে অংশগ্রহণের কথা জানান। এরপর গ্রুপে ও হোয়াটসঅ্যাপে সবার সাথে মতবিনিময় করে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তখন জানিয়েছিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ তারিখের সিদ্ধান্ত।
এরপর বাড়ি থেকে আমার মা ফোন করে জানালেন—‘ঢাকার বক্তব্যের ক্লিপ চলে গেছে ভোলার লালমোহন থানা পুলিশের হাতে।’ রাত ২ টার সময় বাড়িতে পুলিশ এসেছিল আব্বাকে ধরে নিতে। বাবা আগেই খবর পেয়ে বাড়ি থেকে সরে গেলেন, বাসায় উপস্থিত সবাইকে গালিগালাজ করে পুলিশ চলে গেলো। ১৭ তারিখ—আমি সিএনজি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম রাজু’র উদ্দেশ্যে, শাহবাগে পুলিশ আটকে দেয়। পাশেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মিছিল দিচ্ছিলো লাঠি হাতে। তখনও মাথায় হলুদ কাপড় বাঁধা, আরেকটা মিছিল চলে গেল দেশীয় অস্ত্র হাতে। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, আমি সিএনজি থেকে না নেমে সিএনজি ঘুরিয়ে চলে গেলাম নীলক্ষেত গেটে, সেখান দিয়েও ঢাবিতে প্রবেশ করতে দেয়া হলো না।
আমার সাথে যুক্ত হলো সাদাফ। পুলিশের সাথে বাড়াবাড়ি করলে তখন আটক করবে এটা স্পষ্ট। সেজন্য তারপর রিকশা নিয়ে চলে গেলাম ফুলার রোডে। তখন বুয়েটের দিক থেকে আসা একটা দলসহ আরও অনেকেই ছিলাম তখন। আমাদের সঙ্গে তখন যুক্ত হলো পুলিশের বাঁধা। তারা আমাদের কোনোভাবেই রাজু ভাস্কর্যের দিকে ঢুকতে দিবে না। পরে শহীদ মিনারে তাদের সাথে গায়েবানা জানাজা পরলাম। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা হলে চলে গেল, আমরা অনেকেই তখন শহীদ মিনারে স্লোগান দিচ্ছি। এরপর শহীদুল্লাহ হল থেকে একটা মিছিল আসল।
সবাই যুক্ত হওয়ায় পুলিশ আমাদের আটকে রাখতে পারেনি। আমরা মিছিল নিয়ে স্লোগানে স্লোগানে জড়ো হলাম ভিসি চত্বরে। পুলিশ, বিজিবি, হাজারের বেশি আমাদের রাজু ভাস্কর্যের রাস্তা ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছে। ভিসি চত্বরের সেখানেই জানাজা অনুষ্ঠিত হলো, দোয়া শেষ করে কফিন কাঁধে স্লোগান শুরু, মিছিল নিয়ে গন্তব্য রাজু ভাস্কর্য। পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে প্রথম ব্যারিকেড ভেঙে এপিসিকে পিছনে নিতে বাধ্য করে জনতার মিছিল। মোটামুটি ৩মিটার যাওয়ার পরেই টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, ছররা গুলি ছোড়া শুরু।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনের সমর্থনে রাজপথে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
ভিসি চত্বর ও রাজু ভাস্কর্যের দিকে দম বন্ধ হুয়ার মতো অবস্থা। তখন বাধ্য হয়েই কফিনের বাক্স রাস্তায় রেখে সবাই চারদিকে দৌড়াচ্ছিলো। আমার বাম পায়ের সাথে সাউন্ড গ্রেনেড ফোটে; কানের শব্দ তখন বন্ধ হয়ে যায়। সাথে নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। কোনোমতে ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের কাঁটাতারের দেয়াল পেরিয়ে ভিতরে পৌঁছায়। সাথে মেয়েদেরকেও দেয়ালের উপর দিয়ে ভিতরে ঠেলে দেই। অনেককেই তখন দেয়াল বন্ধ চারপাশে আটকাপড়া। আমাদের মধ্যে একজন নারিকেল পাতায় আগুন জ্বালালে তার তাপ নিচ্ছিলাম টিয়ার শেল যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য।
এরই মধ্যে বদ্ধ বিল্ডিংয়ের মধ্যে আবার টিয়ারগ্যাস ছোড়া হয়। মেয়েদের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। আমরা কোন মতে সহ্য করছি। সেখানে থাকার আর কোনো উপায় নেই। কাঠের নড়বড়ে টেবিলের সহযোগিতায় পাঁচ থেকে ছয়জন কাঁটাতারের উপর দিয়ে লাইব্রেরির সামনের রাস্তায় বের করে দিয়েছিলাম। এরই মধ্যে ভাষা শিক্ষার ভিতর দিয়ে কেউ একজন গেট খুলে সেদিক দিয়ে রের হতে বলে। সেদিন দিয়ে সবাই বেরিয়ে লাইব্রেরির সামনের রাস্তায় অবস্থান নেই। পুলিশ আমাদেরকে ঘিরে ফেলছিল। গুলি ছুড়তে থাকে, সাথে আমাদের লক্ষ্য করে ছুড়ে দেয়া ইটপাটকেল। আমরা কোনোভাবেই প্রতিহত করতে পারছিলাম না, বাধ্য হয়েই পিছনে হটি।
‘বিজয় ৭১’ হলের সামনের সেদিক থেকে শুরু হয় পালটাপালটি হামলা। টিয়ারগ্যাসে শিক্ষার্থীদের অবস্থা খুবই খারাপ, আগুনে তাপ নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে হান্নান মাসুদ ভাই গুলি খেয়ে আহত। রক্তে প্যান্ট ভিজে গেছে তার। দু’জন ধরাধরি করে তাঁকে নিয়ে যেতে পারছিল না, তখন আমি ধরি। এরপর তিনজন মিলে জিয়া হলের পিছনের পকেট গেটের দিকে নিয়ে যাই, উদ্দেশ্য হাসপাতালে পৌঁছানো। পকেট গেটের সেদিকে যেতে না যেতেই ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।
নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো করা দলদের বলতে চাই—আপনারা আপনাদের রাজনৈতিক দলের সংস্কার নিশ্চিত করেন। আগের প্যাটার্নে রাজনীতি নতুন বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়।
আমরা সেদিক থেকে তাকে নিয়ে এসে জিয়া হলের সামনের মাঠে ঘাসের উপর বসাই। পরবর্তীতে একটা রিকশাযোগে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা বিজয় ৭১ হলের সামনে অবস্থান করি। পুলিশ হামলা করতে করতে এদিকে অগ্রসর হচ্ছিল। হলের প্রভোস্ট এসে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হয়ে যেতে বলে। পুলিশকে হামলা বন্ধ করতে বলে। শিক্ষার্থীরা কান্না করতে করতে হল থেকে যাচ্ছিলো। সারজিস আলম ভাইকে কল দেই তার অবস্থান জানতে। তখন নাহিদ ভাইয়েরা সহ মিটিংয়ে ছিলেন সামনের পরিকল্পনা নিয়ে।
আমরা প্রায় ৬টার পর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করি। এরপর শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে বের হই সেখান থেকে। আমরা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ এটা প্রশাসন জানলে গ্রেপ্তার নিশ্চিত। রাতে বাসায় ফিরি, হামলার শিকার হয়ে রক্ত টক-বক করছিলো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে মিটিং হয় আমাদের ৩৫বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্ত হয়—আমরা একসাথে শাটডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো। আমাদের বসুন্ধরা আশেপাশের সকল শিক্ষার্থীরা বসুন্ধরা গেট (প্রগতি সরণি) ব্লক করে সাটডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো।
আমি রাতেই ভিডিও বার্তায় ১৭ তারিখ হামলা ঘটনা তুলে ধরে ১৮ তারিখের কর্মসূচি ঘোষণা করি। সকাল ৮টা থেকে নর্থ সাউথ ৮নং গেটে জড়ো হই। স্লোগান দিচ্ছিলাম পুলিশ রাগান্বিত চোখে আমাদের দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তাঁদের সঙ্গে কথোপকথন হয়। আমি ঠান্ডা মাথায় ঘোষণা করি কর্মসূচি হবে। পুলিশের এএসপি জানিয়েছিলেন, ‘আপনারা যদি রাস্তায় নামেন আজ কিন্তু গুলি করবো।’ আমি বুঝতে পারছিলাম—খারাপ কিছুই হবে হয়ত আজ। ভাটারা থানার ওসি আমাকে বলেন, আপনাকে কিন্তু খুব ভালো করে চিনি। আমি টার্গেটেড হই ১৬ তারিখে। এটা তখন স্পষ্ট। খুব কম সময়ের মধ্যে এআইইউবি, আইইউবি, গ্রিন ইউনির্ভাসিটিসহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হই।
আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার চেয়ে রাস্তায় ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা
তখন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় নর্থ সাউথের ৮নং গেট। এরপর আমাদের মিছিলের গন্তব্য সি ব্লকের প্রধান সড়ক ধরে প্রগতি সরণির দিকে। পিছনে তখন হাজার হাজার সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রগতি সরণি পৌঁছাই। পুলিশের ডিআইজি, এআইজি, এসপিসহ উপস্থিত কর্মকর্তারা আমাকে ডেকে নেয়। তাদের কথায় স্পষ্ট—রাস্তায় আন্দোলন কর্মসূচি করতে দেবে না কোনোভাবেই। আমাদের উপস্থিতি বিবেচনায় তারা বলে—আপনারা এখানে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করেন—আমরা আপনাদের কোন ক্ষতি করবো না।
এর ঠিক মিনিট কয়েক পরেই খবর আসে ব্র্যাকে হামলা হয়েছে, গুলি ছোড়া হয়েছে। নতুন বাজার এলাকায় ইউআইইউসহ আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাটারা থানার সমনে অবরোধ করে রেখেছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে সবাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে যাবো। যাওয়া উচিত—এমনটাই বলাবলি করছিলাম। তখনই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার খবর আসে। তখন আমি মাইকে ঘোষণা দেই আমরা কোন ভাবেই ব্র্যাকে যাবো না।
এখন পরিস্থিতি আমরা চাইলেও সবাইকে রক্ষা করতে পারবো না। আমার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে ১৫-২০ জনের মতো শিক্ষার্থীরা তখন বলেন ‘আমাদের ভাইরা মার খাচ্ছে, আর আমরা এখানে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করবো?’ আমরা যাবই বলে তারা রওনা হয়। উপস্থিত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে চাপ দেয়—আপনারা এখান থেকে মুভ করবেন না।’ আমি তখন তাকে বলি—‘শিক্ষার্থীরা আমাদের কথা শুনছে না।’ তিনি জবাবে জানান—‘তাহলে আমাদের কিছু করার নাই।’ তখন আমি নিশ্চিত হই—সামনে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে।
নুর হোসেন দিবসে ‘জিরো পয়েন্টে’ বক্তব্য রাখছেন লেখক। সৌজন্যে প্রাপ্ত।
আমি অনুরোধ করি—কোনোভাবেই যেন আমাদের উপর হামলা না করা হয়। আমি মাইকে সবাইকে জানিয়েছিলাম—হামলার শিকার হলে সবাই হবো। আমরা সবাই ব্র্যাকে যাচ্ছি। আমাদের ভাইদের বাঁচাতে।’ জনসমুদ্র নিয়ে আগাচ্ছি, নতুন বাজার পৌঁছাতেই ইউআইইউসহ আশেপাশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরতরা আমাদের সাথে যুক্ত হয়। ভাটারা থানা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আমাদের গন্তব্য ব্র্যাক বিজয়। নতুন বাজার পেরিয়ে বাঁশতলা পেরোনোর পরই পুলিশের টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, গুলি ছোড়া শুরু।
ধোয়ার কারণে রাস্তা অন্ধকার। পাল্টা-পাল্টি হামলা চলমান। পুলিশ গুলি ছুড়ছে। ফলে আমাদের প্রতিরোধ পিছু হটছে। আমার মুখ জ্বলসে গেছে অবস্থা। আশেপাশের বাসা-বাড়ি থেকে পেস্ট রাস্তায় ছুঁড়ে মারছে। হামলা-পালটা হামলা চলমান। আমি হেলান দিয়ে রাস্তার পাশে বসি। পুরো রণক্ষেত্র। আমার সামনে হামলা চলাকালীন সময়ে আমার বাম পাশেই ইউআইইউ’র এক সহযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমাদের মধ্যে ভয়ের লেশমাত্র নেই। সবাই আরও বেশি ক্ষিপআত হয়ে জ্বলে উঠলো। আমি সারজিস আলম ভাইকে কল দেই। চারদিকে গুলি-টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ। আমি বলি ভাই গুলি হচ্ছে ছেলেপেলে মারা যাচ্ছে; কি করবো?
‘তুই মাইক নিয়ে সামনে এগিয়ে যা, বল গুলি যেন না করে’—আমাকে বলেছিলেন সারজিস ভাই। তখন একজন শিক্ষার্থী রিকশা চালাচ্ছেন; আমি মাইক হাতে পুলিশকে অনুরোধ করতে করতে যাচ্ছি। ‘পুলিশ ভাইয়েরা আপনারা গুলি কইরেন না। আমরা আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই’—অনুরোধ ছিল আমাদের। এরপরও গুলি অব্যাহত রাখে পুলিশ। আমরাও প্রতিরোধ অব্যাহত রাখি। অবশেষে পুলিশ তাদের এপিসি নিয়ে একটি ছোট পার্শ্ব রাস্তায় ঢুকে পড়ে। রাস্তায় ছত্রভঙ্গ পুলিশকে হামলার শিকার হতে হয়। তাদের কিছু সদস্য দোকানের মধ্যে আশ্রয় নেয়। আমরা তাদেরকে মারতে নিষেধ করি।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিহত বেশি কেন?
এরপর আমরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির সামনে দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলে। এর মধ্যে তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছুড়ে হত্যা করে। এরপর শিক্ষার্থীরাও তাদের পালটা প্রতিরোধ তৈরি করে। ফলে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। পুলিশের সদস্যরা এরপর কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভেতর অবস্থান নেয়। এরপর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ থেকে তারা হাত-জোঁড় করে ক্ষমা চায়। তখন আমি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করি—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।
এরপর পুলিশ হেলিকপ্টার যোগে পালাতে বাধ্য হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের অনেক আহত শিক্ষার্থী চিকিৎসা নেয়। তখন লাশের সারি দেখে শিক্ষার্থীদের আত্মচিৎকার দেখার কেউ ছিল না। রাস্তায় বিভিন্ন গলির মধ্যে আমাদের বোনেরা শারীরিক হেনস্তার শিকার হয়। নাফিসা মেসেজ করে সেই সময় যে-ই মেসেজ আমি রাতে দেখি। ‘ভাইয়া আমাদের বাঁচান—আমাদেরকে মারতেছে; আপনারা পিছনে আসেন।’ এরপর বিকাল ৪টায় সবাইকে মাইকের ঘোষণা দিয়ে জড়ো করে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে আমরা স্লোগানে স্লোগানে বসুন্ধরার দিকে ফিরে আসি।
বসুন্ধরা গেটে এসে বক্তব্য রাখি—আন্দোলন আজকের মতো শেষ ঘোষণা দিয়ে নর্থ সাউথের দিকে আসি। নাফিসার পা বাঁশ দিয়ে থেঁতলে দেয়া হয়। জিহাদের চোখের নিচে, থুতনিতে ছররা গুলি লাগে। আহতরা আইইউবিতে চিকিৎসা নিচ্ছিলো। আমি আইইউবিতে যাই। সেখানে আন্দোলনে আহত অসংখ্য শিক্ষার্থীকে ফ্রি চিকিৎসা দেয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন গেট বন্ধের নির্দেশ দেয়া ছিল।
এরপর অবশ্য জানতে পারি—আহত কয়েকজন চিকিৎসা নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার থেকে। জিহাদ, নাফিসাকে বাসায় পাঠিয়ে আমি আইইউবির পূর্ব পাশের গেটে যায়। সময় ৭ টার পর—লাঠি হাতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হবে হয়ত; আমি বুঝতে পারি আমার উপর হামলা করবে হয়ত—সেজন্য দ্রুত আইইউবির ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ি। অল্পের জন্যে হামলার হাত থেকে বেঁচে যাই।
সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উত্তর পাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে বাসায় আসি। এরপর থেকে শহিদদের তালিকা আর সহযোদ্ধাদের ফোনে কান্নার রোল পড়ে যায়। সহযোদ্ধাদের মর্মান্তিক মৃত্যু আর আহতদের খবর শুনে হতাশার মেঘে আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো এ-ই সব হতাহতের দায়ভার আমার। আমি কেন জীবিত ফিরলাম? ১৮ তারিখ সকালে আমি ৮ নং গেটে বলেছিলাম—‘আজ যদি গুলি করা হয়, প্রথমে আমার বুকে লাগবে। পরে আমার সহযোদ্ধাদের বুকে লাগবে।’ অথচ আমি বাসায় ফিরলাম সুস্থ শরীরে। শুধু কপালের ডানপাশে একটা ইটের আঘাত পেয়েছিলাম।
১৮ তারিখ—প্রথমে শুনি ৪২ জন; পরে ৫৭; এরপর খবর আসে ৬২ জন শহিদ। নতুন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয় মূলত ১৮ তারিখই—প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের; আমাদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। স্বৈরাচার হাসিনা ভেবেছিল—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দিলে আন্দোলন শেষ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাও তাই ভেবেছিল। কিন্তু না। বাংলাদেশের মেরুদণ্ড বাঁকা থেকে সোজা করে দাঁড়ানো দিন বলা যেতে পারে ১৮ জুলাইকে। আমরা রাতে মিটিং করলাম—তার পরে থেকে নিয়মিত আন্দোলন, কর্মসূচি নিয়ে সারজিস ভাইয়ের সাথে আমার কথা হতো। তাঁকে ডিবি তুলে নিয়ে যাওয়ার ১০ মিনিট পূর্বে বা শেষ কলটা বোধহয় আমরা ছিল।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষতি ৩২ কোটি টাকা
১৯ তারিখ ও অবরোধ কারফিউ ভেঙ্গে আমরা প্রগতি সরণীতে। পুলিশ বিকাল ৫টায় হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করলো। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে আবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ পর্যন্ত অবস্থান নিলাম। শেষ বক্তব্য দিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসার পরে নর্থ সাউথ ৮নং গেটে আসলাম। তখনই কল আসল—কালাচাঁদপুর শিক্ষার্থীদের উপর বাবুল কমিশনার ও তার দলের লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ গুলি করছে। সেখানে আহতদের এভারকেয়ার হাসপাতালে আনা হলো।
এর মধ্যে ১২ বছরের একটা বাচ্চা, মাথায় গুলি লেগে মারা গেল। সেদিন একই সাথে ৩ জন শহিদ। মোট ১২ জন গুলিবিদ্ধ। তাঁদের মধ্যে রিকশাওয়ালা একজন মামার মুখ উড়ে গেছে গুলিতে। পুলিশ তখন পুরোদমে আমাদের খুঁজেছে। ইন্টারনেট অফ। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা ছিল তখন মহাযুদ্ধ। মোবাইল বন্ধ করে নতুন সিম খুললাম। আন্দোলন জারি রাখলাম। বাসা পরিবর্তন করা লাগছে বহুবার। পুরান ঢাকা চলে গেছি আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে। আবার ভোরে বাইকে চলে আসা। নাফিসাকে ২৭ তারিখ সন্ধ্যা ৭ টায় ওর বাবাসহ তুলে নিয়ে যায়। উত্তরা থানায় ডিবি পুলিশ আমার সন্ধান দিতে বলে।
নাফিসার পরিবারকে আমার জন্য খুবই ঝামেলা পোহাতে হয়েছে; যদিও বিজয়ের পরে আন্টি খুবই ভালোবাসা দেখিয়েছেন। আমাকে তখন পুলিশ রামপুরা বিটিভি পোড়ানোর মামলায় আসামি করার জন্য গ্রেপ্তার করতে চেয়েছে—নাফিসার তথ্য মতে। আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আমাদের পাশে দাঁড়ান। নিউজ ২৪ এর পাবেল ভাই আমাদের পত্রিকা দিয়ে সহযোগিতা করে। ৩ তারিখ অবরোধে ২টা পর্যন্ত থেকে আমরা শিক্ষকরাসহ চলে গিয়েছিলাম শহিদ মিনারে। নাহিদ ভাই ১ দফা ঘোষণা করে। ঘোষণা শেষে কথা হয় নাহিদ ভাইয়ের সাথে। বাসায় ফিরি। ৪ তারিখ দেয়াল লিখন কর্মসূচি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ১ নং গেটে বাস্তবায়িত হয়। জীবনের মায়া শেষ।
অবস্থা তখন এমন যে—হাসিনা থাকলে হয় গুলি খেয়ে মরবো, নয় জেলে। আর না হয় রিমান্ডে নির্যাতনে মরবো। বাঁচার একমাত্র উপায় স্বৈরাচারের পতন। ৩৫ জুলাই বা ৪ আগস্ট রাতে সংবিধান জ্বালিয়ে দিয়ে ভিডিও বার্তা দেই। দেশের সকল মানুষকে আহ্বান জানাই আন্দোলনের যোগ দিতে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী সবাইকে মন্ত্রিপরিষদের আদেশ উপেক্ষা করার আহ্বান জানাই তখন।
৫ তারিখ আমাদের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেটে আমাদের উপর হামলা হলো। গুলি করা হলো। শতাধিকের মতো আহত। গুলি লাগা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিলো না এক সহযোদ্ধা ভাইকে ৪তলায় মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসার জন্য যেতে যেতে আমার শার্ট ভিজে গেলো রক্তে। প্যান্টেও রক্তের দাগি রঞ্জিত ছিল।
আমি পরবর্তী সময়ে স্ববিস্তারে বিগত ১৫ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাইয়ের প্রতিটা দিনের বর্ণনা লিখবো। তবে আজকে লেখার উদ্দেশ্য বিপ্লব বেহাত হওয়ার পথে—আমি তা দেখতে পাচ্ছি। আবারও সেই ৯০ গণ-অভ্যুত্থানে পরবর্তী অবস্থা। সেই হযবরল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দিকে হাঁটছে আমার দেশ। আবার ৩০ বছর পরে দেশের ছাত্র জনতাকে জীবন দেয়া লাগবে। সেইফ এক্সিট পাওয়া রাজনীতিবিদরা দেশে আবার পেশিশক্তির নোংরা রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনে সহিসংতা: ১২ দিনে ২৫৩ শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের তথ্য
৩৬ জুলাই সেনাপ্রধান কেন হাসিনাকে দেশত্যাগের সুযোগ দিলো? আমরা যখন গণভবনে মার্চ করি, তখন পোস্ট করেছিলাম—সেনাপ্রধান দেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। এটা টাটকা রক্তের সাথে বেইমানি।
অনেকে সেনাপ্রধানের অবদানকে অতিরঞ্জিত করার চেষ্টা করছে। আমি বলবো—সেনাপ্রধান বাধ্য হয়ে ছাত্র জনতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
শুধু আত্মসমর্পণ করেননি—অভ্যুত্থানবিরোধী ষড়যন্ত্র করেছে হাসিনাকে সহযোগিতা করে। আমি স্পষ্টভাবে বলছি—কোন শতভাগ দেশপ্রেমিক মানুষ আবার হাসিনার স্বৈরাচারী আমলে সেনাপ্রধান হবে, এটা পাগলের প্রলাপ। তবে হ্যাঁ, জুনিয়র অফিসারদের বিবৃতি দেশপ্রেমিক অনেক অফিসারসহ অবসরে থাকা অফিসার সকলের দৃশ্যমান সিদ্ধান্তে জন্য সেনাপ্রধান কোন উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ ছিল না।
আমি বিশ্বাস করি—সেনাবাহিনীর ৯০ শতাংশের বেশি সদস্য দেশপ্রেমিক ও বিবেক সমুন্নত রেখে জীবন জাপান করে। আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম ২ বছর। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। যখন ১৮ এর নির্বাচন বাস্তবতা শুনতে পেরেছি। রাতের ভোটের নির্বাচন। যে সকল সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী ডিউটিতে এসেছে—তাদের মধ্যে টাকা বণ্টন হয়েছে। এই কথা শোনার পরে আমি আর আমার দেশপ্রেম খুঁজে পাই নাই সেনাবাহিনীর চাকরি করে। আপনি দেশপ্রেমিক আবার অবৈধ সরকারের চাকুরিজীবী এটা ভাবা যায়।
আমি দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজনে আমার চাকরিকে বিসর্জন দিয়েছি। আমার বাকী ব্যাচমেটরা কুয়েতে।
২০২২ সালে ১০ ডিসেম্বর ভাবছিলাম দেশ হয়ত স্বৈরাচার মুক্ত হবে। কিন্তু না। বিএনপির সেইফ এক্সিট রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্তের ব্যর্থতায় দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয় নাই। আমার ভাই ২০২২ এর ৮ ডিসেম্বর হামলার শিকার হয়। পায়ের লিগামেন্ট, হাত-পা পিটিয়ে জখম করে ফেলে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।
২০২৩ এর ২৮ অক্টোবর জীবনে প্রথম টিয়ারগ্যাস খাই। সেদিনের রণক্ষেত্রের সাক্ষী আমি। বিএনপি আবারও নেতৃত্বে ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়। গত ৬ জানুয়ারি আমি উদ্যোগ নেই স্বৈরাচার পতনের ডাক দিবো। একটা ভিডিও বার্তা দেশবাসীর জন্য রেকর্ড করি ৫ তারিখ রাতেই।
৬ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন ডাকি কিন্তু কোনো নিউজ চ্যানেল রাজি হয় নাই। যমুনা, সময়, নিউজ ২৪ সহ সবাইকে কল দেই। কিন্তু কেউ রাজি হয় নাই। তালা নিয়ে ছুটে যাই আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে তালা দিবো বলে। তখন সেখানে বিজিবি, পুলিশের ঘেরাও দেয়া ছিল—মিডিয়ার অনেক লোক ছিল। কিন্তু বক্তব্য প্রচারের রাজি ছিল না তারা।
এখন সমাধান প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুসের সাথে সমন্বয়কদের বৈঠকের ব্যবস্থা করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদের সংশোধন করতে হবে। বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের মধ্যে থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে হবে।
মিডিয়াকর্মীরা অনুরোধ করলো—ভাই আপনাকে গুম করে ফেলবে, আমরা নিউজ করতে পারবো না। চরম হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরি। ৭ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচন হলো। আমি টিএসসিতে গিয়েছিলাম আমরণ অনশন করবো বলে। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা সেখানে পাহারায় থাকায় বসতে পারি নাই। এতকিছুর পর এবার স্বৈরাচার মুক্ত সুযোগ হাতছাড়া করি নাই।
আমি আমার দেশ, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। এবার বিপ্লবে প্রমাণ হয়েছে দেশপ্রেমিক মানুষ কারা আসলে। নেতা বা দেশের দায়িত্ব নেয়ার মতো মানুষ তৈরি হয় রাজপথে। কোনো ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ হিসেবে যদি বলি—দেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষিত লোকের অভাব নাই। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে হাল ধরার লোক আছে কতজন।
২৪এর বিপ্লব হয়েছে আমাদের নেতৃত্বে। দেশের মানুষ আস্থা রেখেছে আমাদের ওপর। সরকার কীভাবে হবে—এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ্য অধিকার দেশের মানুষ আমাদের উপর দিয়েছে, এটাই বাস্তব সত্য। কিন্তু এ-ই বিপ্লবের ১২টা বাজানোর পথে নিয়ে গেলেন আসিফ নজরুল, জোনায়েদ সাকি এবং ভুয়া সমন্বয়ক সাজিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা কেন—সেনাপ্রধানের সাথে সরকার কীভাবে গঠিত হবে—সে আলোচনা করতে গেলেন? আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের সাথে কেন আলোচনা করা হলো না? দেশের মানুষ আমাদের ডাকে রাস্তায় নেমেছিল।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনে নিহতদের ৭৫ শতাংশ শিশু-কিশোর-তরুণ
আর উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থিতরা কারা? ৩-৪ জন ছাড়া বাকিদেরকে তো আমরা চিনি না! কোন যোগ্যতা দেখে এদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে? বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের মানুষের দায়িত্ব নেয়া রাজপথের পরীক্ষায় যাঁরা পাশ করেছে—তাদের উপেক্ষা করে দেশকে কাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে?
সেনাপ্রধান সহ কারা কারা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে আগে থেকে তৈরি ছিল—আসিফ নজরুল স্যারের বক্তব্য মতে?
বিপ্লবের স্প্রিরিট কী—এর জবাব, ‘আমার স্বপ্ন।’
দেশের মানুষ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে সরকার। আমি গ্রামে বেড়ে ওঠা তরুণ। আমার বাবা ইউপি সদস্য ছিলেন ২৩ বছর। আমি দেখেছি ইউনিয়ন পরিষদে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া অনুদান প্রাপ্য লোকজন পায়না। অসহায় মানুষের হতাশা ভরা চেহারা আমি সহ্য করতে পারি না। মনে করেন একটা ওয়ার্ডে ৫শ’ লোক আছেন। আর্থিক সমস্যাকবলিত মানুষ আছেন ৫০ জন। ইউনিয়ন পরিষদে সকলের আর্থিক হিসাব থাকবে। যেকোনো অনুদান আসলে অবশ্যই সবচেয়ে অসহায় অবস্থা যাদের, তাদেরকে সরকারি সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ, জমায়েত ব্র্যাক ও বিইউবিটি শিক্ষার্থীদের
আমি দেখেছি—কীভাবে সচিব, ডিসি, এসপি, ইউএনও সরকারি প্রজেক্ট নিজেদের মনোনীত লোকদের কাজ পাইয়ে দেয়। রাজনৈতিক নেতাদের হয়ে তারা কাজ করেন। পার্সেন্টেজ খায় ভাগে যোগে। সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাজ পাওয়ার অধিকার বঞ্চিত করা হয়। পাশাপাশি কাজের মান কেমন করে—তা সবার জানা। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে কোন রাজনৈতিক প্রভাব এ-ই বাংলাদেশে থাকবে না। নতুন বাংলাদেশে তা রাখা চলবে না; রাখা যাবে না।
সকল শ্রেণি পেশার মানুষ অধিকার নিয়ে বাঁচবে। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে। তৃণমূল থেকে রাজধানী সবখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আমি মনে করি—এটাই ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট।
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া যেকোনো জায়গায় কোনো সাধারণ মানুষের সাথে অন্যায় হলে—তার বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করবে সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর বাস্তব চিত্র হলো—সবাই রাজনীতিকে ব্যবসার সবচেয়ে বড় মাধ্যম মনে করে। নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক পেশিশক্তি ব্যবহারের সুযোগ থাকবে না। মামলা করে ন্যায় বিচারের জন্য ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। আমার বিপ্লবের সরকার কি আমার এ-ই স্বপ্ন জানে? অধ্যাপক ইউনুস সাহেব কি জানেন—কেমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আমি জীবন বাজি রেখেছি।
আরও পড়ুন: বিরুলিয়ায় কোটা আন্দোলনে নেমেছে ৪ বেসরকারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা
আমার সাথে বা বিপ্লবী আমার সহযোদ্ধাদের সাথেই তো এ-ই সরকারের কোনো সম্পর্ক নাই। আসিফ ভাই নাহিদ ভাই ব্যতীত আমাদের সমন্বয়কদের অধিকাংশদের আমরা চিনি না উপদেষ্টাদের, তারা-ও চিনেন না আমাদের। তাহলে বিপ্লবীদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবে কীভাবে? দেশের মানুষের আমাদের উপর আস্থার বাস্তব চিত্র বর্ণনার সময় দেশবাসী স্পষ্ট করেছে। সুতরাং দেশের মানুষের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে হবে।
নতুন বাংলাদেশে শহিদের রক্ত বৃথা যাওয়ার উদাহরণ হলো—কিছুদিন পূর্বে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশে সারাদেশে ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২ লক্ষ টাকা করে ঘুষ বিনিময়ের মাধ্যমে। এটাই তাহলে নতুন বাংলাদেশ! সারাদেশে চাঁদাবাজি, জমি দখল, মামলা বাণিজ্য চলমান।
এখন সমাধান বা করণীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুসের সাথে সমন্বয়কদের বৈঠকের ব্যবস্থা করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদের সংশোধন করতে হবে। এটা নাহিদ ভাই করবেন, তার দেশ নিয়ে চিন্তার সাথে আমাদের চিন্তার বিনিময় করতে হবে। বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের মধ্যে থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে হবে। কমপক্ষে ১০ জন বা তারও অধিক (বিপ্লবে নেতৃত্বের অবদানের ভিত্তি হবে যোগ্যতা)। নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ। সেজন্য সবখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলেই এই বিপ্লব সার্থক হবে।
আরও পড়ুন: রামপুরায় ব্র্যাকের শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত ১
আমি প্রশ্ন ছুড়ে দিতে চাই—৯০এর গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে কেন? দায়ী কে? জানতে চাই। রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে—এটা দেশের মানুষের অধিকার। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক দলের মতামত নিতে হবে। তবে সমস্যা সমাধানের আগে—নির্বাচনের আলাপ শহিদদের সাথে প্রহসন।
নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো করা দলদের বলতে চাই—আপনারা আপনাদের রাজনৈতিক দলের সংস্কার নিশ্চিত করেন। আগের প্যাটার্নে রাজনীতি নতুন বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়। ৩৬ জুলাইয়ে পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর অনধিকার চর্চা চলমান। জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ হতাশ হয়ে বলছে—‘আগেই ভালো ছিলাম।’ বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশের যোদ্ধাদের জন্য এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে!
আগামীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের বিকল্প নাই। তবে উপদেষ্টা পরিষদে পরিবর্তন আনতে হবে। অতিদ্রুত ফারুকী ও বশিরদের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বহিষ্কার করতে হবে। আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের আত্মমর্যাদারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এই সরকার ব্যর্থ হবে—এটা দেশবাসী হতে দিবে না। কারণ তারা জীবন দিয়ে বাঁচার লড়াই জারি রেখেছে।
লেখক: সমন্বয়ক, সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন;
শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।