বাইরে থেকে এসে ছাত্ররাজনীতি করেন ঢাবির ১৯ সভাপতি-সম্পাদক
- তাওসিফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৩ PM , আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৬ PM
কিছুদিন আগেও কোন কক্ষে কে থাকবেন, কে হলে উঠতে পারবেন, কে পারবেন না—এসব নির্ধারণ করে দিতেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঐতিহাসিক ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি বদলেছে। ছাত্রত্ব শেষ হলে হলে থাকার সুযোগ নেই। এ নীতিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে বেশিরভাগ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এখন হলে অবস্থান করতে পারছেন না। তাদের অনেকেই ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে এর ফলে নেতাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কমে যাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। হলের আবাসিক জীবনের অভাব তাদের শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝতে এবং ঘনিষ্ঠ মিথস্ক্রিয়া তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে স্বীকার করেছেন অনেক ছাত্রনেতা।
১৩টি ছাত্র সংগঠনের খোঁজ নিয়ে যায়, ২৬ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ১৯ জনই হলে থাকেন না। তাদের কেউ কেউ ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার কারণে থাকার সুযোগ না পেলেও কেউ কেউ ব্যক্তিগত কারণে বাইরে থাকেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সভাপতি গনেশ চন্দ্র রায় সাহস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তার হল জগন্নাথ হল। এই শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী। তার সিট বরাদ্দ ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। তারা কেউ হলে থাকেন না।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু সাদিক কায়েম হলে না থাকলেও সাধারণ সম্পাদক এসএম ফরহাদ অনিয়মিত হলে থাকেন বলে জানা যায়। সাদিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং মাস্টারদা সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। ফরহাদ সমাজকল্যাণ বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের এবং কবি জসীমউদ্দিন হলের আবাসিক ছাত্র। হলে তার সিটের মেয়াদ আছে বলে জানান শাখা প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হোসাইন আহমাদ জুবায়ের।
অন্যদিকে, প্রায় একই চিত্র বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের। জানা যায়, সভাপতি মেঘমল্লার বসু শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এবং জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি এখন হলে থাকেন না। সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং তিনি মহসিন হলে থাকেন।
কিন্তু বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাবি শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের হলে থাকার বৈধতা থাকলেও তারা থাকেন না। শাখাটির সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী। সাধারণ সম্পাদক সামি আব্দুল্লাহ আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের এই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং বিজয় ৭১ হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবি আহ্বায়ক মো. সানাউল্লাহ হক আরবি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তার আবাসিক হল মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল। শাখাটির সদস্য সচিব রকিবুল ইসলাম মার্কেটিং বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তার আবাসিক হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। তবে তারা দুজনই হলে থাকেন না।
ইনকিলাব মঞ্চের ঢাবি শাখার সভাপতি মো. সাঈদ হাসান স্বাস্থ্য অর্থনীতির ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। কিন্তু তিনি হলে থাকেন না। তবে সুফিয়া কামাল হলে থাকেন শাখাটির সাধারণ সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমা। তাসনিম ক্রিমিনলোজি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (একাংশ) এর ঢাবি সুহাইল আহমেদ শুভ অর্থনীতি বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বর্তমানে হলে থাকেন না। শাখাটির সাধারণ সম্পাদক অদিতি ইসলাম বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে থাকেন। অদিতি দর্শন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী।
বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ ঢাবি শাখা আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ জিহাদ ভুঁইয়া উর্দু বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও কবি জসীম উদ্দীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তবে তিনি হলে থাকেন না। তবে শাখার সদস্য সচিব একই শিক্ষাবর্ষের জুবায়ের হাসিব সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক কেউ হলে থাকেন না। সভাপতি আরমানুল হক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও কবি জসিমউদ্দীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। সাধারণ সম্পাদক সাকিবুর রনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থী।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (একাংশ) এর ঢাবি সভাপতি সাদিকুর ইসলাম সাদিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি হলে থাকেন না। সাধারণ সম্পাদক চাকরিতে প্রবেশ করায় এখন বেশিরভাগ দায়িত্ব পালন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক। তিনি ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকেন।
রোকেয়া হল হলে থাকেন বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ ঢাবি শাখার সানোয়ারা খাতুন। সানোয়ারা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। তবে সদস্য সচিব মুহিব মুশফিক খান হলে থাকেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
ইসলামী ছাত্র মজলিসের ঢাবি শাখার সভাপতি ইবনে সালমান আরবি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তিনি হলে থাকেন না। সাধারণ সম্পাদক মো: নূরে আলম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তার আবাসিক হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এখন আর থাকেন না।
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামালুদ্দীন মুহাম্মদ খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তার হল কবি জসীমউদ্দীন হল। সদস্য সচিব হাসান ইনাম ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও মাস্টারদা' সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তবে তারা কেউ থাকেন না।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি সভাপতি আরমানুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাজনীতি করতে হলে শিক্ষার্থীদের সাথে থাকার বিকল্প নেই। আমি আজিমপুরে ছিলাম পুরোটা সময়। ক্যাম্পাসে সাইকেল নিয়ে হয়ত যাচ্ছি। আমার হল জসিমউদ্দীন হল। হলে থাকতে পারলে প্রতিনিয়ত অসংখ্য শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ হতো। আমার যে গণতান্ত্রিক লড়াই এবং ক্যাম্পেইন সেগুলো চালাতে সুবিধা হত। আমরা বৈধ সিটের কথা কেন বলি? বৈধ সিট নিশ্চিত হলে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা থাকে। বৈধ সিট থাকলে হাসিনার পতন অনেক আগেই হয়ে যেত। হলে থাকতে না পারাটা ক্ষতির কারণ হয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীদের সাথে ইন্টারেকশনে একটা দূরত্ব তৈরি হয়।
জামালুদ্দীন মুহাম্মদ খালিদ বলেন, আমি তো ক্যাম্পাস জীবনে হলেই উঠতে পারিনি কখনো। তাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি বাইরে থেকেই। আর ৫ আগস্টের পর শুধু-শুধু আর উঠতে চাইনি। এমনিতেই জায়গা কম। আমার জায়গায় একজন ছোট ভাই থাকতে পারলে সেটাই উত্তম ভেবে আর যাইনি হলে।
তিনি আরো বলেন, হলে না থাকায় হলপাড়ার রাজনীতিতে কিছুটা ব্যাকফুটে তো অবশ্যই। তবুও মৌলিক ও গঠনমূলক কাজ করলে এটা তেমন ফ্যাক্ট হয় না বলেই মনে করি।
ঢাবি শিবির সভাপতি আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘যাদের ছাত্র তো শেষ, তাদের অন্যতম দায়িত্ব হল নিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া। ২৪-র অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এই পরিবেশটা তৈরি হয়েছে। এই জায়গায় ছাত্র নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব হল এই সিস্টেমটি প্রতিষ্ঠিত করা।’ তবে বাইরে থেকে এসে রাজনীতি করায় সমস্যা হচ্ছেনা বলে জানান এই ছাত্রনেতা।
তিনি বলেন, একটা ছেলের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং কথা বলার যথেষ্ট স্পেস আছে। ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সবার কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে।
ঢাবি কমিটিতে নিয়মিত শিক্ষার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সবসময় সেটাই চেষ্টা করি। আমাদের কমিটি দেখলে বুঝবেন, ছাত্রের বাইরে কেউ থাকেনা। শিবিরে অছাত্রদের ঠিকানা নেই। আমাদের ১৪ জনের কমিটিতে ১১ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী। আর আমরা ৩ জন সদ্য মাস্টার্স পাশ করেছি। এখন এমফিলে আছি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির জন্য আলাদাভাবে অনেক বছর ছাত্রত্ব ধরে রাখা অনুচিত। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের রাজনীতি চর্চায় আরো বেশি এনগেজ থাকা উচিত।