‘হাত নেই মেনে নিতে হবে—যা স্বপ্ন দেখতাম, তা তো আর সম্ভব না’
‘চিন্তা করে লাভ নেই, আমার এক হাত নেই, এটা মেনে নিতে হবে। আগে যা যা স্বপ্ন দেখতাম, তা তো এখন আর সম্ভব নয়। চিন্তা ও স্বপ্নে পরিবর্তন আনতে হবে। আর যে হাত কাটা গেছে, তার তো কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ হয় না, কোটি টাকা দিলেও হাত ফিরে পাব না।’ কথাগুলো ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলিতে ডান হাত হারানো তরুণ আতিকুল ইসলামের।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) আগারগাঁও পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় বসে এসব কথা বলেন তিনি। রাজধানীর উত্তরা আজমপুর পরিবারের সঙ্গে থাকেন আতিক পরিবারের ছয় ভাই বোনের সবার ছোট। বাবা আলাল উদ্দিন পুরোনো ফার্নিচারের ব্যবসা করেন ও মা আমেনা বেগম গৃহিণী। উত্তরা আজমপুরে একটি মার্কেটে বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করতেন।
আন্দোলনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের মৌন সমর্থন করে আসছিলেন আতিক। সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে স্লোগান এবং মিছিলেও শামিল হয়েছেন বহুবার। তিনি বলেন, ‘প্রতিজ্ঞা করে আন্দোলনে নেমেছিলাম। হয় মরব, নয়তো বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব। বিজয় পেয়েছি, তাই হাত না থাকার কষ্টটা মনে আনি না’।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার দিনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আতিক বলেন, ৫ আগস্ট, উত্তর আজমপুরে বেলা ১১টা থেকে সবার সঙ্গে আমিও ছিলাম। গোলাগুলি শুরু হয় আনুমানিক বিকাল ৪টার দিকে। আমি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম প্রথম থেকেই। গুলি খাই ৫ আগস্ট। স্বৈরাচার সরকারের যখন পতন হয়েছে। তখন ইন্ডিয়ান আর্মিদের উত্তরা থেকে এয়ারপোর্ট পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করতেই শুরু হয় গোলাগুলি।
ওরা উত্তরা থানা থেকে বের হয়ে গুলি করতে করতে এয়ারপোর্টের দিকে আগাচ্ছিল। এছাড়া তারা তো পালাতে পারত না। তাই ওরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালাচ্ছিল। আন্দোলনের শেষ দিন ৫ আগস্ট ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ দিন বলে জানান আতিকুল।
৫ আগস্ট বিকেলের ঘটনার বর্ণনায় আতিক বলেন, সেই বিকালে আমাদের সামনেই কয়েকজন মারা যান। আহত হয় আরো অনেক জন। আমরা রাস্তার এপার থেকে চলে যাই ওপারে, কারণ পুলিশ গুলি করছিল। আমি আর একটা ভাই দাঁড়িয়ে ছিলাম একটু দূরে। দেখি আমাদের এক ছাত্র ভাই পড়ে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারি ওর পায়ে গুলি লেগেছে, দৌড়ে গুলি লাগা ছেলেটার কাছে যাওয়ার আগেই আমাকেও গুলি করে দেয়। একে-৪৭ এর একটা গুলি এসে লাগে আমার ডান হাতে।
২ থেকে ৪ সেকেন্ডের মতো আমি কিছু অনুভব করতে পারিনি তার পরেই দেখি আমার হাতটা ঝুলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার হাতে কোনো হাড় নেই, শুধু চামড়ায় হাত ঝুলে আছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তখন বুঝতে পারি আমার হাতে গুলি লেগেছে। প্রথমে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন এবং পরে স্বজনেরা পাঁচটি হাসপাতাল ঘোরেন। একটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁর হাতের গুলিটি বের করেন। চিকিৎসক চেষ্টা করেছে হাত রাখতে, কিন্তু আমার হাতের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। পরে ১৪ তারিখ পঙ্গু হাসপাতালেই আমার হাত কেটে বাদ দেওয়া হয়। যোগ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে সন্ত্রাসীদের হাতে সেনা কর্মকর্তা নিহত
আতিকুল বলেন, আগে আমি ছিলাম পূর্ণ মানুষ, তখর স্বপ্নগুলো ছিল অন্যরকম। কিন্তু এখন, এক হাতে নিয়ে কীভাবে কী করা যায়, সেটা ভাবতে হবে। আমি আগে শরীর ও মনে যেমন শক্ত ছিলাম, এখন তেমনটা নেই। কারণ আমার ডান হাতটা চলে গেছে। মানসিকভাবে শক্তি নেই যে, সেটা বলব না। কারণ প্রতিজ্ঞা করেই মাঠে নেমেছিলাম হয়ত মরব, নয়তো বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব। কিন্তু মারা তো যাইনি, তবে এমন ভাবে বেঁচে আছি সেটা একরকম না বাঁচার মতোই।