১৯ জুলাই ২০২৩, ২১:০৮

এক কমিটিতেই দেড় যুগ পার, কর্মীদের বাড়ছে বিশৃঙ্খলা

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠার দেড় যুগের মধ্যে মাত্র একটি কমিটি পেয়েছে শাখা ছাত্রলীগ। তাও আবার ১৫ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগের এই ইউনিটে নিয়মিত কমিটি না হওয়ায় একদিকে উঠে আসছে না দক্ষ নেতৃত্ব। অন্যদিকে, কোন সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা না থাকায় এখানকার কর্মীদের মধ্যে দিনদিন বেড়েই চলছে বিশৃংখলা।

জানা যায়, ছাত্রলীগের পরিচয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটছে। নিয়মিত কমিটি না হওয়ায় ছাত্রলীগ পরিচয়ে সহজেই যেকেউ এ ধরনের অপরাধে সহজেই জড়িয়ে যাচ্ছেন। এতে করে এসব অপরাধের জন্য সাংগঠনিক কোন ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, আবাসিক হলে গাঁজা সেবন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার হুমকিসহ অধিকাংশ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত এই ইউনিটের ছাত্রলীগের নামধারী কর্মীরা। নানা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হলেও কােন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি অপরাধীদের বিরুদ্ধে। 

এদিকে, দীর্ঘ দুই বছর পর এই ইউনিটটিতে কমিটি গঠনে ফের তোড়জোড় দেখা গেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে। গত মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শাখা ছাত্রলীগের কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) আহবান করা হয়। এতে আগামী সাত দিনের মধ্যে দলীয় কার্যালয়ে দপ্তর সেলে সিভি জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। 

এর আগে ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শাখা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি (রবিন-ধ্রুব) বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। পরে ১৫ দিনের মধ্যে প্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) নিয়ে নতুন কমিটি করার ঘোষণা দেন তারা। তবে তারা কমিটি দিতে পরেনি। এবারও জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) নিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হবে কিনা সেটা নিয়ে শাখা ছাত্রলীগে চলছে জল্পনা-কল্পনা।

আরও পড়ুনঃ মির্জা ফখরুল এখন ‘মিথ্যা ফখরুল’: সাদ্দাম

জানা যায়, ২০০৬ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর পর ২০১৭ সালে এসে রবিন-ধ্রুবের নেতৃত্বে শাখা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি অনুমোদন করা হয়। ওই বছরের ১৮ অক্টোবর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি এক বছরের জন্য অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নোবিপ্রবি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শফিকুল ইসলাম রবিন এবং সাকিব মোশাররফ ধ্রুব সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এদিকে ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর নোবিপ্রবি কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন উপ-ক্রীড়া সম্পাদক শরীফ বায়েজীদ ইবনে মাহমুদ কোতোয়াল, উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক এস এম মাহবুবুর রহমান সালেহী, সহ-সম্পাদক সৈয়দ ফয়সাল হাসান পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত গ্রহণ করেন। এতে দুইটি শীর্ষ পদের জন্য জীবন বৃত্তান্ত জমা দেন ৪১২ প্রার্থী। তবে নিজেদের কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এই ইউনিটের কমিটি দিয়ে যেতে পারেননি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জয়-লেখক। 

এদিকে, প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি থাকাকালীন শেষ দিকের সময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে থাকেন  শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। এইসব কর্মীর বিরুদ্ধে কমিটি থাকাকালীন সময়েও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কমিটি বিলুপ্তির পর নতুন কমিটি আলোচনায় আসলে বাড়তে থাকে ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। শীর্ষ পদপ্রার্থীরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত সময় পার করতে থাকেন। এদিকে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়াতে থাকেন তাদের কর্মীরা। 
 
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৩ মার্চ জুনিয়র কর্তৃক সিনিয়রের সাথে বেয়াদবির জেরে দুই গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘসময় ধরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে রাত ১০টার দিকে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করে ক্যাম্পাস শান্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই ঘটনার ক’দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় টং দোকানের সম্মুখে ৩ ছাত্রলীগকর্মী দ্বারা বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী তাওফিক আহমেদ খান মারধরের শিকার। এর কিছদিন আগেই ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ জুনিয়র শিক্ষার্থকে দলে ভেড়ানোকে কেন্দ্র করে দুিই গ্রুপের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শান্তিনিকেতনে তুমুল সংঘর্ষ হয়। 

গতবছরের শেষদিকে প্রশাসন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম উদ্দিন রাফিকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে। একই দিনে সংবাদ সংগ্রহে গেলে আরটিভির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদককে হেনস্থা করে ছাত্রলীগকর্মী নাঈম মোস্তফা, শাকিল মোস্তফা, আকরাম হোসাইন, হাসিব শান্ত এবং প্রলেক্স বড়ুয়া সহ তাদের গ্রুপের অন্যান্য কর্মীরা। একইবছর ২ নভেম্বর নোবিপ্রবি ছাত্রলীগের এক কর্মীর সালাম হলে গাঁজা খাওয়ার ভিডিও তার বান্ধবীকে প্রেরণ করা নিয়ে ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মে মাসে মাইজদী থেকে ক্যাম্পাসে রাতের বাসে ফেরার পথে গায়ের সাথে গা লাগাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেট গেইটে হট্টগোলে জড়ায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। 

২০২২ সালের ২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিনিকেতনে মো.জিল্লুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইটের সামনে ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা এপ্লাইড ক্যামিস্ট্রি এন্ড ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হন। এরআগে ২৪ মার্চ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দুই বন্ধুর গালাগালি কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়ামের পাশে প্রশান্তি পার্কে হাতাহাতি ও হট্টগোলে জড়ায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের কর্মীরা। এরআগে ৫ মার্চ মালেক হলে নিজের রুমে ডেকে এনে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকেই মারধর করে অন্য কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের ইভটিজিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন কর্মী। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পাঁচছাত্রীকে মনোসারনি নামক জায়গায় ইভটিজিং করে কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। এছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীকে হলের সিট ছাড়ার হুমকির অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগকর্মী রিয়নের বিরুদ্ধে।

এসব ঘটনায় জড়িত অন্তত ২০ এর অধিক ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সর্বোচ্চ ২ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার দেয়া হয়েছে। এছাড়া অর্ধশতাধিক নেতা কর্মীকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি ও আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে।

বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি গ্রুপকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নানান কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। এসব গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাঈম রহমান, মোহাইমিনুল ইসলাম নুহাশ, জাহিদ হাসান শুভ, নজরুল ইসলাম নাঈম এবং আক্তারুজ্জামান জিসান। তাদের দাবি, কমিটি থাকা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের চেয়েও ভাল কাজ করছে এই ইউনিটের ছাত্রলীগ কর্মীরা। 

এসব পদপ্রত্যাশীরা বলেন, স্বীকৃতি না থাকায় ছাত্রলীগ পরিচয়ে কেউ অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। কমিটি না থাকলেও এই ইউনিটের ছাত্রলীগ কর্মীরা আদর্শের জায়গায় একত্রিত বিধায় স্বাধীনতা বিরোধী বা দেশ বিরোধী কোন সংগঠনের কার্যক্রম নেই বলে দাবি পদপ্রত্যাশীদের। 

তবে কোন সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকলেও গোপনে অবস্থান থাকতে পারে বলে মনে করছেন ছাত্রলীগ পদপ্রার্থীদের কেউ কেউ। ভিন্ন গ্রুপে রাজনীতি করলেও এই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মিল রয়েছে দাবি করে পদপ্রার্থীরা আরও জানায়, আমরা সার্বক্ষণিক সচেতন রয়েছি; দেশবিরোধী কার্যক্রমে কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আমরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করবো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে গতিশীল করতে যোগ্যদের দিয়ে একটি কমিটি করে সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা। তারা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ইউনিটের কমিটি দ্রুত গঠন করা দরকার; এতে নির্বাচনকে ঘিরে নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে দলীয় প্রতিকের বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করবে।

শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি প্রসঙ্গে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করে সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করার জন্য ইতিমধ্যে আমরা জীবনবৃত্তান্ত আহবান করেছি। জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে দ্রুত একটি সুন্দর কমিটি গঠন করে এই ইউনিটকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বদ্ধ পরিকর। তবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগের সুস্পষ্ট তথ্য, প্রমাণ পাওয়া গেলে নতুন কমিটি করার সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সেটি বিবেচনা করবে। 

ঢালাওভাবে অভিযোগের উপর ভিত্তি করে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রমাণ মিললে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।