প্রেস রিলিজ কমিটি, পদ বাণিজ্য: বছরজুড়ে আলোচনায় জয়-লেখক
ঘুষ নেওয়াসহ অন্যান্য বিতর্কে ২০১৯ সালে পদ হারিয়েছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী। এই দুই নেতার স্থলে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যকে নির্বাচিত করেছিলেন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধান, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ৪ মাস পর তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০১৯ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সংগঠনের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করার অভিযোগ তোলে ছাত্রলীগের একটি অংশ। ২০২২ সালে এসে বেশি সমালোচিত হতে থাকেন জয়-লেখক। এসময় ছাত্রলীগ নেতাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও জয়-লেখকের সমালোচনা করতে দেখা গেছে।
যেসব কারণে সমালোচিত জয়-লেখক:
গঠনতন্ত্র না মানা: ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটিকে ২ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের জন্য কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু জয়-লেখক তা করতে পারেননি।
ছাত্রলীগ নেতারা অভিযোগ করেছিলেন, জয়-লেখক কমিটির তিন বছরে দুই মাস পরপর ১৮টি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা, সেখানে হয়েছে মাত্র একটি। সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামতও নেননি তারা। ফলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতারা কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা ও সাংগঠনিক বিষয়ে তাদের মতামত, এমনকি অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারেননি।
আরও পড়ুন : এক ঘণ্টায় ৬ ইউনিটে ‘জয়-লেখকের প্রেস রিলিজ’ কমিটি
সম্মেলন ছাড়া প্রেস রিলিজ কমিটি ও কমিটি বাণিজ্য: জয়-লেখক সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন সম্মেলন না করে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করে। গঠনতন্ত্রে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণার কথা থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া প্রত্যেকটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে।
গত ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এই সম্মেলনের আগে নিজেদের মেয়াদের শেষ কয়েকদিনে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করে জয়-লেখক। এর মধ্যে গত ৭ নভেম্বর রাত ৮টার পর এক ঘন্টার ব্যবধানে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে ৬টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি।
এর আগে গত জুলাই মাসের শেষ দিকে এক দিনে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে ১১টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করে জয়-লেখক। এছাড়াও, ২০২২ সাল জুড়ে বিভিন্ন সময় জয়-লেখকের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে বিভিন্ন ইউনিটের কমিটির বিজ্ঞপ্তি দেখা গেছে।
প্রেস রিলিজ নির্ভর এসব কমিটি ঘোষণার পরই শুরু হয় বিতর্ক। ছাত্রলীগ নেতারা অভিযোগ করেছিলেন, অর্র্থের বিনিময়ে বিএনপি পরিবারের সদস্য এবং অপকর্মের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে আজীবন বহিষ্কৃত, অছাত্র, বিবাহিত, মাদক মামলার আসামিদের বিভিন্ন ইউনিট কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।
তড়িঘড়ি করে কমিটি ঘোষণা প্রসঙ্গে সংগঠনটির সদ্য সাবেক সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ বলেছিলেন, এটি সংগঠনের জন্য কাম্য হতে পারে না। এটি সংগঠনের নিয়মবর্হি:ভুত। সভাপতি-সেক্রেটারি এ কমিটিগুলো এতোদিন ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রেখেছেন এবং যখন দেখছেন আর ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছেন না তখনই শেষ সময়ে বাধ্য হয়ে এবং নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে বাছ-বিচার ছাড়ায় রাতের অন্ধকারে সম্মেলন ব্যাতীত প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করছেন।
কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য সংখ্যা জানতেন না জয়-লেখক: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩০১ জনের বেশি সদস্য থাকার কথা নয়। কিন্তু নিজেদের মেয়াদের শেষ দিকে এসে কোনো বাধ বিচার ছাড়াই বিভিন্ন জনকে শুধু চিঠি দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদায়ন করেছিলেন জয়-লেখক। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি কত সদস্য বিশিষ্ট ছিল সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কোনো উত্তর দিতে পারেননি জয়-লেখক। ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, ২০২২ সালের আগস্ট মাসেই ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। আর নভেম্বর মাসের শেষের দিকে আরও ৫ শতাধিক ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন : হলের কক্ষে তালা, জয়-লেখক থাকেন বিলাসী ফ্ল্যাটে
জয়-লেখকের বিলাসী জীবন: ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদে দায়িত্ব পাওয়ার পর হলের কক্ষ ছেড়ে বিলাস বহুল ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেন জয়-লেখক। বাইক ছেড়ে চড়েন দামি গাড়িতে। ছাত্রলীগ নেতারা অভিযোগ করেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই দুইজনের চলাফেরায় পরিবর্তন আসে। হল ছেড়ে জয় উঠেন নিউমার্কেটের পাশে বিশ্বাস বিল্ডার্সের একটি ফ্ল্যাটে। লেখক উঠেন ইস্কাটন গার্ডেনের একটি বাসায়। জয় চলাফেরার জন্য ব্যবহার করতেন পাজারো এবং প্রিমিও ব্র্যান্ডের দুইটি গাড়ি। আর লেখক ভট্টাচার্য চড়তেন কালো কালারের নোয়া গাড়িতে।
এসব বিষয়ে সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি সোহান খান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ভারমুক্ত হওয়ার পরই তাদের আচরণ পাল্টে যায়। কেন্দ্রীয় কমিটির বাকীদের বাদ দিয়ে তারা দুইজনই সব করতে থাকেন। বিলাসী জীবন যাপন শুরু করেন। দিনে এক গাড়িতে চললে দেখা যায় রাতে আরেক গাড়িতে চলছেন। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার না করলেও বরাবরই পাশ কাটিয়ে গেছেন জয়-লেখক।
আরও পড়ুন : জয়-লেখকের ‘অপকর্মের’ ফিরিস্তি আজই প্রধানমন্ত্রীকে দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতারা
ছাত্রলীগের একাংশ জয়-লেখকের অপকর্মের ফিরিস্তি নিয়ে আ’লীগ অফিসে: গত ১০ সেপ্টেম্বর জয় ও লেখকের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি অনিয়মের তালিকার অভিযোগপত্র সিলগালা করে ধানমন্ডিতে সভানেত্রীর কার্যালয়ে জমা দিতে যান সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদের শতাধিক নেতা। আ’লীগের দপ্তর সেল সেই অভিযোগ পত্র গ্রহণ না করলে পরে তারা অভিযোগপত্রটি ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের চার নেতার কাছে হস্তান্তর করেন।
সেই অভিযোগপত্রে, ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার স্বেচ্ছাচারিতা, কেন্দ্রীয় নেতাদের অবমূল্যায়ন, পদ-বাণিজ্য, প্রেস রিলিজের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ছাড়া কমিটি গঠন, চাঁদাবাজ, মাদকসেবী, ছাত্রদল ও শিবিরকর্মীদের কমিটিতে পদায়নসহ সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে জানিয়েছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি কামাল খান।
কমিটি দেওয়ার ক্ষমতা বাতিল: জয়-লেখকের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতারা। সমালোচনার মুখে এক সময় তারা জয়-লেখকের কমিটি দেয়ার ক্ষমতা বাতিল করে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছিলেন, নতুন করে ছাত্রলীগের আর কোনো কমিটি ঘোষণা করা হবে না। এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : নিউমার্কেটে অবরুদ্ধ ছাত্রলীগ সভাপতি জয়
নিউমার্কেট এলাকায় অবরুদ্ধ জয়: কমিটি ঘোষণার দাবিতে গত ৪ ডিসেম্বর আল নাহিয়ান খান জয়কে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকের গাড়িবহরও আটকে দেয় তারা। তবে অবরুদ্ধ থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আল নাহিয়ান খান জয় ওই ঘটনাকে বলেছিলেন, এটা সম্পূর্ণ গুজব।
অভিযোগ অস্বীকার, আ’লীগ নেতাদের দোষারোপ: গত ২১ নভেম্বর মধুর ক্যানটিনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন জয়-লেখক। সেখানে ছাত্রলীগের পদবাণিজ্য, কমিটি বাণিজ্য, মাদকসেবী-কারবারি ও অনুপ্রবেশকারীদের পদায়নসহ সবকিছুর অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভুয়া আখ্যায়িত করে ছাত্রলীগকে বিতর্কমুক্ত করতে পেরেছেন বলে দাবি করেন সাবেক এই দুই নেতা।
নিজেদের বিরুদ্ধে উঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে তাঁরা বলেন, বিভিন্ন সময় যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি মিথ্যা। তাঁরা ৭৯টি ইউনিট কমিটি করেছেন। অর্থের বিনিময়ে তাঁরা কোনো কমিটি করেননি। এমনকি তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের দেওয়া বক্তব্যকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলেও দাবি করেছেন জয়-লেখক।