২০ মে ২০২৩, ১১:২৫

পেশাদার ফুটবলে যোগ দিতে পড়ালেখা ছাড়েন রোনালদো

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো  © সংগৃহীত

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো দেড় দশকে জাদুকরী ফুটবল উপহার দিয়ে জয় করে নিয়েছেন ফুটবলপ্রেমীদের মন। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভেঙেছেন অনেক রেকর্ড, গড়েছেন ইতিহাসও। বর্তমানে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বিশ্বজুড়ে অনেক উঠতি খেলোয়াড়ের রোল মডেল। ফুটবলেরর বাইরে ব্যক্তি রোনালদোকেও বেশিরভাগ মানুষ পছন্দ করেন। তার প্রতিটি গোল, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি অর্জন নিজেদের মনে করে উদযাপন করেন বিশ্বের মিলিয়ন মিলিয়ন ভক্ত।

আট থেকে আশি, রোনালদোর পায়ের জাদুতে কে মোহিত হয় না? তিনি খেলতে নামলে সবাই যেন প্রার্থনায় বসে যায়, জাদুকরের পা থেকে একটি গোলের আশায় তাকিয়ে থাকেন চাতক পাখির মতো। অন্যরা যেখানে একসময় পেরে না উঠে হাল ছেড়ে দেয়, সেখানে জাতীয় দল ও ক্লাব সবখানেই ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচে গোল, অ্যাসিস্ট, হ্যাটট্রিক বা দারুণ সব মুহূর্ত উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে ফুটবলে রোনালদোর চেয়ে সেরা এই পৃথিবীতে কয়জন আছেন?

অপ্রতিরোধ্য এই মানবের জন্ম ১৯৮৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি পর্তুগালের পশ্চিমে অবস্থিত মাদেইরা নামের ছোট্ট একটি দ্বীপে জন্ম নেন। শৈশব থেকেই তার পরিবার দারিদ্র্যের মাঝে বেড়ে ওঠে। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রোনালদো। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের নাম অনুযায়ী ছেলের নাম রোনালদো রাখেন তার বাবা।

তিনি স্পোর্টিং-এর যুব একাডেমিতে যোগদানের জন্য মাদেইরা থেকে লিসবনের কাছাকাছি আলকোচেতে চলে যান। ১৪ বছর বয়সে রোনালদো বিশ্বাস করতেন তিনি আধা-পেশাদারভাবে খেলার ক্ষমতা রাখেন। পরে ফুটবলে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্য পড়ালেখা বন্ধ করতে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।

তার মা ছিলেন একজন রাঁধুনী, আর বাবা ছিলেন বাগানের মালী। স্কুলে রোনালদোকে তার সহপাঠীরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। কারণ তার বাবা স্কুলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবেও মাঝেমধ্যে কাজ করতেন। বলার মতো তার তেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। তিনি কখনো উচ্চ বিদ্যালয় শেষ করতে করেননি। শৈশবে রোনালদো একটি সাধারণ একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৪ বছর বয়সে পড়ালেখায় ক্ষান্ত দিয়ে ফুটবলে জড়িয়ে পড়েন। ১৬ বছর বয়সে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবে সুযোগ পান তিনি। এরপর আর পড়ালেখায় ফেরা হয়নি।

উইকিপিডিয়ায় রোনালদোর শিক্ষাজীবন নিয়ে বলা হয়েছে,  রোনালদো ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ফুটবল ক্লাব আন্দোরিনহার হয়ে খেলেন। যেখানে তার বাবা ছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ১৯৯৭ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি স্পোর্টিং সিপির সাথে তিন দিনের ট্রায়ালে যান। এ ট্রায়ালে তাকে ১৫০০ পাউন্ডের বিনিময়ে স্বাক্ষর করেছিলেন।

আরও পড়ুন: আই নো বাংলাদেশ, আই লাভ বাংলাদেশ: রোনালদো

পরবর্তীকালে তিনি স্পোর্টিং-এর যুব একাডেমিতে যোগদানের জন্য মাদেইরা থেকে লিসবনের কাছাকাছি আলকোচেতে চলে যান। ১৪ বছর বয়সে রোনালদো বিশ্বাস করতেন তিনি আধা-পেশাদারভাবে খেলার ক্ষমতা রাখেন। পরে ফুটবলে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্য পড়ালেখা বন্ধ করতে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।

তিনি ৬ষ্ঠ গ্রেডের বাইরে স্কুলে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। স্কুলে পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে তার সঙ্গে একটা বিপত্তি। তিনি স্কুলে একবার কোনো একটা বিষয় নিয়ে তার শিক্ষকের দিকে চেয়ার ছুড়ে মারেন। পরে তাকে এ অপরাধে স্কুল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল।

একটা পর্যায়ে দারিদ্র্য-অপমানের দুঃখ ভুলতে শিশু রোনালদো বেছে নেন ফুটবলকে। হাতের কাছে একবার ফুটবল পেলে আর কিছু লাগতো না তাঁর, সব কষ্ট ভুলে যেতেন! এতোটাই খেলার পাগল ছিলেন, যে ঘুমানোর সময়ও ফুটবল জড়িয়ে ধরে ঘুমাতেন! পড়ালেখায় একদমই মন ছিল না তার। তার মা পড়াশোনার কথা বললেই রোনালদোর ঝটপট উত্তর হতো, ‘আজকে স্কুলে কোন হোমওয়ার্ক দেয়নি তো!’ তাও জোর করে পড়তে বসালে, মা একটু চোখের আড়াল হলেই চুপিচুপি ফুটবল হাতে জানালা দিয়ে পালিয়ে বেরিয়ে পড়তেন রোনালদো!

ছোটবেলা থেকেই বেশ চঞ্চল ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো। তার মা মারিয়া ডলরেস আভেইরো একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সে স্কুল থেকে ফিরলে আমি যখনই জিজ্ঞেস করতাম কোন হোমওয়ার্ক রয়েছে কিনা সে বলত নেই। এরপর আমি রাতের খাবার তৈরি করতে গেলেই সে জানালা দিয়ে পালাত।’ ডলরেস আরও জানান রোনালদো এতটাই জোরে ছুটতে পারতেন যে কেউই ধরতে পারত না তাকে। এ কারণে অনেকে ‘ছোট্ট মৌমাছি’ বলে ডাকত তাকে।

সাফল্যের পাশাপাশি কম সমালোচনার শিকার হন না রোনালদো। কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "Your love makes me strong, your hate makes me unstoppable!" যখন সমস্ত পৃথিবী তার বিরুদ্ধে চলে যায়, চারপাশ থেকে তীরের মতো ছুটে আসে সমালোচনা, তখন রনের নিশ্চয়ই প্রচন্ড মনে পড়ে বাবাকে। যিনি ছিলেন তার খেলার সবচেয়ে বড় ভক্ত।

পর্তুগালের মেজর লীগ প্রাইমেরিয়া লীগে-২০০২ সালে ডেব্যু হয় রোনালদোর। প্রথম ম্যাচেই দুই গোল করে দলকে জয় এনে দেন তিনি। 

২০০৩ সালে মাত্র আঠার বছর বয়সে তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে চুক্তি করেন ১২ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে। তিনি ক্লাবটির ইতিহাসে প্রথম পর্তুগিজ খেলোয়াড় ছিলেন। সেখানে তিনি দারুণ কৃতিত্বের সাথে ভূমিকা রাখেন ক্লাবের জন্য। ২০০৮ সালে ফিফা সেরা খেলোয়ার এওয়ার্ড পান, এমনকি তিনটি প্রিমিয়ার লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে সহায়তা করেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে।

এছাড়াও দুই সিজনে প্রিমিয়ার লীগের ‘প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’ নির্বাচিত হোন তিনি। রোনালদোর বিশেষত্ব ছিল স্পিড, ড্রিবলিং, হেড ও ফ্রি-কিক গোল। ডি-বক্সের বাইরে থেকে গোল করাও ছিল রোনালদোর স্পেশালিটি। ২০০৯ সালে পোর্তোর সাথে ৪০ গজ দূর থেকে করা চোখ ধাঁধানো গোল করে সে বছরের পুসকাস অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন তিনি।

২০০৯ সালে তিনি রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান রেকর্ড ১৩১ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে! তারপর থেকে রিয়ালকেই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছেন। ক্লাবটির ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হিসেবেও ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বিবেচিত হন তিনি।

শুধু ক্লাবেই নয়, জাতীয় দলেও রোনালদো লড়াকু সিংহের মতোই খেলেন! পর্তুগালের জার্সি গায়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। বলতে গেলে তাঁর উপর ভর করেই ফুটবলের পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পর্তুগাল, স্বপ্ন দেখেছে বিশ্বকাপেও অভাবনীয় কিছু করে দেখানোর।

অধিকাংশ ফুটবল তারকা শরীরের নানাবিধ স্থানে ট্যাটু অঙ্কন করলেও দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কখনোই ‘ট্যাটু’ করেননি রোনালদো। কারণটা অবশ্য মানবিক। ক্যারিয়ারের প্রায় শুরু থেকেই নিয়মিত রক্তদান করে থাকেন এই ফরোয়ার্ড। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রেড ক্রস শরীরে ট্যাটু করার এক বছরের মধ্যে রক্তদান অনুৎসাহিত করে থাকেন। আর সে কারণেই রোনালদোর শরীরে নেই কোন ট্যাটু।

রিয়াল মাদ্রিদের বাকি খেলোয়াড়দের সাথে রোনালদোর রসায়ন ছিল দেখার মতো। বিশেষ করে লেফট ব্যাক মার্সেলো যেন ক্রস করলেই ফিনিশিং এর জন্য দৈবিকভাবে হাজির হতেন রোনালদো। বল পায়ে দ্রুতগতির ড্রিবলিং এ ক্রিস্টিয়ানো হার মানিয়েছেন তখনকার সব সেরা ডিফেন্ডারদেরকে। ডিবক্সের ভেতর তার পায়ে বল যাওয়া মানেই গোল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এছাড়াও হেড, ফ্রিকিক, লং রেঞ্জ থেকে করেছেন অসংখ্য দূর্দান্ত গোল। ফুটবলের ইতিহাসে এসব মূহুর্ত নিশ্চিতভাবেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

ফুটবল পিচের দারুণ দক্ষতা রোনালদোকে ব্যক্তিজীবনেও এনে দিয়েছে অনেক সম্মান। ২০১৬ সালে দেশকে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা এনে দেয়ার পর মাদেইরার বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

অধিকাংশ ফুটবল তারকা শরীরের নানাবিধ স্থানে ট্যাটু অঙ্কন করলেও দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কখনোই ‘ট্যাটু’ করেননি রোনালদো। কারণটা অবশ্য মানবিক। ক্যারিয়ারের প্রায় শুরু থেকেই নিয়মিত রক্তদান করে থাকেন এই ফরোয়ার্ড। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রেড ক্রস শরীরে ট্যাটু করার এক বছরের মধ্যে রক্তদান অনুৎসাহিত করে থাকেন। আর সে কারণেই রোনালদোর শরীরে নেই কোন ট্যাটু। যাদের শরীরে উলকি আছে, তাঁদের রক্ত দেওয়ার জন্য ছয় মাস বা এক বছর অপেক্ষা করতে হয়।

সমাজসেবী হিসেবে অনেক আগেই সুনাম কুড়িয়েছেন এই মহাতারকা। আর একারণে অনেকেই তাকে ‘ম্যান উইথ আ গোল্ডেন হার্ট’ বলে থাকেন।

আরও পড়ুন: ম্যানইউ ছেড়ে সৌদির ক্লাবে রোনালদো

ক্যারিয়ারে পাঁচটা ব্যালন ডি'অর জিতেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ২০০৮, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭। এরমধ্যে ২০১৭ সালে একটি ব্যালন ডি'অর তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন দুঃস্থ শিশুদের সাহায্যে। সাধারণত এই পুরস্কারগুলো সামনে রাখেন প্লেয়াররা। কিন্তু রোনালদোর ক্ষেত্রে সেটা আলাদা। এই পাঁচটা ব্যালন ডি’অরের মধ্যে তিনি একটা ব্যালন ডি’অর বিক্রি করে দিয়েছেন। জানা যায়, তিনি ব্যালন ডি’অর বিক্রি করেছিলেন চ্যারিটিকে সাহায্য করার জন্য।

যেটি লন্ডনের একটি জায়গায় নিলাম হয়। ইজরায়েলের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ৬ লাখ ইউরোতে সেটি কিনে নেন। সেই টাকাটি যায় একটি চ্যারিটিতে। বিশ্বের যেসব শিশুরা মারণরোগে আক্রান্ত তাঁদের জন্য এই চ্যারিটি কাজ করে। ২০১৭ সালে রোনালদো। শেষবার ব্যালন ডি’অর জেতেন। এরপর আর CR7-এর হাতে ওঠেনি সেরার পুরস্কার।

কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রোনালদোর ওপর আলাদা একটি কোর্স পড়ানো হয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওকান্যাগান ক্যাম্পাসের ওই কোর্সের মূল প্রতিপাদ্য সমাজ ও সংস্কৃতিতে রোনালদোর প্রভাব।

দেশের হয়ে জিতেছেন দুটি ন্যাশনাল ট্রফি। ২০১৬ সালে ইউরো এবং ২০১৯ সালে উয়েফা ন্যাশনস লীগ। দুটিতেই রোনালদোর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ইউরোর ফাইনালে ইঞ্জুরড হয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার মাঠ ছাড়ার দৃশ্য এখনো ভক্তদের চোখে ভাসে।

পায়ে ব্যান্ডেজ বাধা অবস্থায়ও ডাগআউটে কোচের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যান্য খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছিলেন রোনালদো। এমন প্রেরণাদায়ী আচরণ ও নেতৃত্বের নিদর্শন ক্রিস্টিয়ানোই দেখাতে পারেন। যাহোক, অ্যাডারের গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় পর্তুগাল। রোনালদো একজন গোল মেশিন। পরিপূর্ণ ফুটবল খেলোয়াড় বলতে যা বোঝায় তাই তিনি। খেলেছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ তিন দলে। এনে দিয়েছেন অনেক জয়। খাদের কিনারা থেকে এক হাতে দলকে বাচিয়ে এনেছেন বহুবার।